ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি সবসময়ই কৌশলী। প্যালেস্টাইনের ওপর ইসরায়েলের সামরিক অভিযান নিয়ে ভারত একাধিকবার “ভারসাম্যপূর্ণ” অবস্থান নিয়েছে। অথচ, প্রতিবেশী বাংলাদেশে ঘটে চলা নানা সংকট, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের অতি আগ্রহ প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে, যখন এদেশের নেতারা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সরব হন, তখন বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁদের “না বললেই নয়” প্রতিক্রিয়া অনেক কিছুই ইঙ্গিত দেয়।
ভারত ঐতিহ্যগতভাবে প্যালেস্টাইনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে। অবশ্য নেহরু-ইন্দিরা-রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস আমলে স্পষ্ট ছিল। কিন্তু বিজেপি সরকার আসার পর এই নীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলেন মোদী সরকার, যা কূটনৈতিক মহলে নতুন বার্তা দেয়।
২০২৩-২৪ সালে গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস হামলার সময়ও ভারতের অবস্থান ছিল পরোক্ষ সমর্থনের মতো। জাতিসংঘে ভারত প্যালেস্টাইনপন্থী প্রস্তাবে ভোট দিলেও, মোদী সরকার সরাসরি ইসরায়েলের সমালোচনা এড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে, ভারত-ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাণিজ্য গত কয়েক বছরে বহুগুণে বেড়েছে। বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে ইসরায়েলের জায়োনিস্ট নীতির মিল থাকায় মোদী সরকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে,বাংলাদেশের বিষয়ে নীরবতা কৌশল না উদাসীনতা?
বাংলাদেশে নানা রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধী দলের দমন-পীড়নসহ একাধিক ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহল সরব হলেও, ভারত সরকার প্রায়শই নীরব থেকেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের ওপর দমনমূলক পদক্ষেপের সময় ভারতীয় সরকার কোনো বড় প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু কেন এই নীরবতা? তারই কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে সরকার স্থিতিশীল হলে তা ভারতের জন্য যথেষ্ট লাভজনক। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ক যথেষ্ট দৃঢ় হয়েছিল একসময়। তাতে বাণিজ্য এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বেড়েছিল। ভারতের বিজেপি সরকার কোন মতেই চায়না যে, বাংলাদেশের ক্ষমতার পরিবর্তন হয়ে এমন কোন সরকার আসুক যারা ভারত বিরোধী। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করে বিজেপি সরকার। কিন্তু রাজনৈতিক নিপীড়ন কিংবা গণতন্ত্রের সংকট নিয়ে কখনোই মুখ খুলতে দেখা যায় না তাদের। বাংলাদেশের উপর অতিরিক্ত নাক গলাতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ আসাম সহ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিকে নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে ভারতকে।
বাংলাদেশে দিনের পর দিন প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে চীনের। সেই নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ভারত। শ্রীলঙ্কার মত বাংলাদেশ ও চীনের কাছ থেকে বিশাল পরিমাণে ঋণ নিয়েছে এবং অবকাঠামো প্রকল্পে উপস্থিতি বেড়েছে চীনের। তাই ভারত চায়না রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বাংলাদেশ চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ুক। মোদী সরকার অনেক সময় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নিয়ে সরব হয়। সেটা বেশিরভাগ সময় রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক বিষয়ের উপর। কিন্তু বাংলাদেশের ইস্যু নিয়ে সবসময় নিরপেক্ষ মনোভাব বজায় রাখেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ ভারত সরকার মনে করে, বাংলাদেশের যাই ঘটুক না কেন নিজেদের, স্বার্থ সুরক্ষা থাকলেই হল।
প্যালেস্টাইনের বিষয়ে ভারত ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু ইসরায়েলের প্রতি নৈতিক সহানুভূতি বজায় রাখা হচ্ছে। আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হবে। তবে সে ক্ষেত্রে ভারত কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে সেটাই দেখার। “প্যালেস্টাইন-ভিয়েতনামের জন্য কাঁদা মন” আর “বাংলাদেশের বেলায় নীরব থাকা” – এই দ্বৈত নীতি মোদী সরকারের বৃহত্তর কৌশলের অংশ।