অভিজিৎ বসু
আজ শুধু ভাষাকে ভালোবেসে তাকে বুকে আগলে রাখার একটা দিন। যে দিনটা শুধুই বাংলা ভাষার জন্য বরাদ্দ গোটা একটা দিন। যে দিন আব্দুল আর জব্বার এরা সেই তাদের প্রাণের ভাষাকে ভালোবেসেই শহীদ হলো বুকের রক্ত দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করলো। আজ সেই ভাষা দিবসের দিনে সাত সকালেই মনে পড়ে যায় আমার সেই ছোটো বেলার কথা। সেই কালো স্লেট আর সাদা পেন্সিলে লেখা অ, আ, ই, আর ঈ। যে ছোটো ছোট বর্ণ আজ আমার জীবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ভাবেই নানা রূপে। যাকে ভালোবেসে বড়ো হওয়া আমার। সেই ছোটো বেলায় ভয় পেয়ে ‘মা’ বলে আঁতকে ওঠা। আমার বর্ণপরিচয় তো এই ভাষার হাত ধরেই। যে বর্ণপরিচয় আজও আমাদের রক্তে, মজ্জায়, শিরায়, উপশিরায় আর ধমনীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আজও বেঁচে আছে।
সেই ভাষার চর্যায় যার পথ চলা শুরু। সেই পথের দু’পাশে ছড়িয়ে আছে হলুদ সবুজ সর্ষে ক্ষেতের মতই পদাবলীর মিষ্টি মধুর সুর। আর কীর্তনের মাতাল করা কণ্ঠ। আর সেই পাঁচালির চেনা ছন্দ। যে ছন্দ আমাদের মুগ্ধ করে। যে ছন্দ আমাদের সবাইকে আবিল করে দেয় বারবার। এই রবিঠাকুর, লালন, অতুল প্রসাদের গান আমাদের হৃদয়ে বাজে এই বসন্তের বাতাস গায়ে মেখে। মাইকেল, জীবনানন্দ, সুনীল, শক্তির কবিতা আমাদের মননে। আমাদের ভাষার এই চলার পথে নানা চড়াই আর উতরায়। এই ভাষা সয়েছে নানা বর্গি আক্রমণ; খান সেনাদের অত্যাচার। তাঁর বুকের উপর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে দুই রাষ্ট্র। ভারত – বাংলাদেশ। ফেব্রুয়ারির ২১ তা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভাষার কোনও দেশ নেই, যেমন নেই ভালোবাসার।
১৯৯৯ -এ এই দিনটিকে স্মরণে রেখে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি। বিশ্বের পঞ্চম বহুল ব্যবহৃত এই ভাষা। বিশ্বজুড়ে ৩০ কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায় এই বাংলা ভাষায়। গোটা পৃথিবীতে দু’টি দেশের জাতীয় সঙ্গীত এই ভাষায়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের গর্ব। তবুও ‘আমরা বাংলা গিয়েছি ভুলি’। সত্যিই অসাধারণ এই ক্ষয়িষ্ণু ভাষার ভেঙে পড়া আজ এই ইতিহাস। ইউনেস্কোর হিসেব অনুযায়ী, ১০ হাজারের এর কম মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষার বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গত ৬০ বছরে প্রায় ২৫০ ভারতীয় ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ২৫০০ ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার বিপদ সম্মুখীন। যার মধ্যে এমন কিছু ভাষা আছে যাতে কথা বলে হয়তো আর জনা তিরিশেক মানুষ। রোজের জীবনে যে ভাষায় অভ্যস্ত সেই ভাষায় শিক্ষার সুযোগ নেই বিশ্বের ৪০ শতাংশ মানুষের। ভয় হয়, বড্ড ভয়…। এই প্রাণের বাংলা ভাষা নিয়ে ভয় হয়, বড্ড ভয় হয় যে আজও।
পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, বাঁকুড়ার আর হুগলীর ওই ছেলেটার ভাষা শুনে হাসি। মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার, দিনাজপুরের মেয়েটার কথা শুনে আড়ালে আবডালে মজা। আচ্ছা, এভাবেই কি? না….। আমার ভাষা উন্নাসিকতার নয়। ‘যিখানে মাটি লালে লাল’, এ ভাষা গড়াগড়ি খায় সেখানে। এ ভাষা মাঝি, মাল্লার ভাষা। এ ভাষা বাউল – ফকিরের ভাষা। এ ভাষার শিকড় লুকিয়ে পাহাড়ে, জঙ্গলে, বনে, বাদাড়ে, নদীতে, পুকুরে, মাঠে, ঘাটে সর্বত্র। ছোটবেলায় লেখায় ভুল করলে বকা খেয়েছি। আজও বকা-ধমক খায়। ভুল লিখি, আর শিখি। এভাবেই যেন এগিয়ে চলে। থমকে যেন না যায়। আমার বর্ণমালা যেন দুখিনী না হয়…..। আজ বাংলা ভাষার দিবসে ভাষাকে ভালোবেসে আরও গভীর রূপে একটু আঁকড়ে ধরা। আর মনে মনে বলা
‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে
অন্ধ বাউলের একতারা বাজে
উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে,
উত্তাল নদীর বাঁকে বাঁকে;
নদীও নর্তকী হয়’