একসময় সামনে পিছনে পাইক বরকন্দাজ নিয়ে পথে নামতেন হোমড়া চোমরারা। যে যত ওজনদার তার সাথে তত বেশি লোকলস্কর। দেখে সভয়ে রাস্তা ছেড়ে সাত হাত দূরে সরে দাঁড়াত আম আদমি। দূর থেকেই সেলাম ঠুকত তারা। রাজা রাজরাদের ব্যাপার তো আলাদা একদম। সেই হোমরা চোমড়ারা এ যুগে তারাই এখন ভিআইপি। অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আমাদের চারপাশে। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ক’জন হতে পারেন? নিশ্চয়ই হাতেগোনা, গন্ডায় গন্ডায় ভিআইপি কি হতে পারে? হতেই পারে যদি দল ক্ষমতায় থাকে। দিল্লিতে ক্ষমতায় বিজেপি। তাই সে দলের ন’কড়া ছ’কড়ার নেতারাও এখন ভিআইপি। তাদের পিছনে থাকে ভারী বন্দুক হাতে জলপাই উর্দি পরা সান্ত্রীরা। যে যত ‘গুরুত্বপূর্ণ ‘ তার পিছনের পাহারাদারের ভিড়ও ততই বেশি। আবার গুরুত্বেরও একটা ক্যাটাগরি আছে। জেড, জেড প্লাস, ওয়াই, ওয়াই প্লাস এইরকম নানা স্তর আর সেইমতো বাড়ে কমে পাহারাদারের সংখ্যাও। আর তার ওপর নির্ভর করে নেতাদের স্ট্যাটাস আর ক্ষমতা।
এই যেমন সদ্য এ রাজ্যের ৩২ জন বিজেপি নেতার নিরাপত্তারক্ষী তুলে নিয়েছে অমিত শাহর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। আর সেই সুবাদে জানা গিয়েছে কোন ভিআইপিরা আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ান পেয়ে আসছিলেন। তপশিলি জাতি-উপজাতি জাতীয় কমিশনের প্রাক্তন সহ-সভাপতি অরুণ হালদার, কোচবিহারের বিজেপি নেতা অভিজিৎ বর্মন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সভাপতি অভিজিৎ দাস, নেতা অজয় রায়, নদিয়ার জেলা সভাপতি অর্জুন বিশ্বাস, উলুবেড়িয়ার সাংসদ প্রার্থী অরুণোদয় পাল চৌধুরী, আরামবাগের সাংসদ প্রার্থী অরূপকান্তি দিগর, জয়নগর-মজিলপুরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের নেতা অশোক কাণ্ডারি — এমন গাদাগুচ্ছের নাম আছে এই তালিকায়। ক’জন তাঁদের নাম শুনেছে সন্দেহ আছে। অমিত শাহর মন্ত্রক মনে করেছিল তাঁদের প্রাণের বিপদ আছে। তাই সরকারি খরচে ঢালাও কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে আলিপুরদুয়ারের প্রাক্তন সাংসদ জন বার্লাও রয়েছেন। পদ্ম ছেড়ে জোড়া ফুলের দিকে ঝুঁকতেই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে তাঁর নামও। এখন তাঁর ঝুঁকি অনেক কমে গিয়েছে। বাদ পড়াদের মধ্যে সাতজন গত লোকসভা ভোটে বিজেপির হয়ে এরাজ্য থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই হেরেছেন। ছ’জন জেলা সভাপতিও রয়েছেন। কেন্দ্রীয় পাহারা তুলে নেওয়া হয়েছে নদিয়া, উত্তর দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, ঘাটাল ও কলকাতা উত্তর সাংগঠনিক জেলার সভাপতিদের।
অবশ্য এই প্রথম নয়। এর আগেও শুভেন্দু অধিকারীর জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের ২৪ জন আর সন্দেশখালি সহ উত্তর ২৪ পরগনার ১৩ জন নাম না জানা নেতার কেন্দ্রীয় পাহারা তুলে নেওয়া হয়েছে। ভোটের পর হামলার যুক্তিতে একেবারে মুড়ি মুড়কির মতো বিলি করা হয়েছে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা। এর মধ্যে প্রাক্তন সাংসদ অর্জুন সিং দল বদলাবদলির পর থেকেই জেড হয়েছেন। এ বাদে বিজেপির ৭৭ জন বিধায়কই সিআরপিএফ, সিআইএসএফের জওয়ান নিয়ে ঘোরেন। তাঁরা সবাই ভয়ঙ্কর হামলার বিপদে রয়েছেন, এমনটাই দিল্লির বক্তব্য। এঁদের মধ্যে ১৬ জন এক্স ক্যাটাগরির বেশি পাহারা পেয়ে থাকেন। বাকিরা এক্স ক্যাটাগরি। এই নিরাপত্তার লিস্টে যেমন মুকুল রায় আছেন, তেমনই আছেন এ রাজ্যের তিনজন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। আছেন দিলীপ ঘোষ, লকেট চ্যাটার্জির মতো প্রাক্তনরাও।
বোঝা মুশকিল নয় এই গাদা গাদা পাহারার আয়োজন কেন, কোন অঙ্কে। দল রাখতে খুচরো নেতাদের খুশি রাখতে হবে। তাদের পিছনে পাহারাদার দিলে এলাকায় তাদের কদর বাড়ে। স্ট্যাটাস সিম্বল বলে কথা! তাছাড়া একইসঙ্গে এ রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার কী দুরবস্থা সেটাও তুলে ধরা সবার সামনে। রাজ্যের পুলিশে ভরসা নেই বিজেপি নেতাদের। তাই কেন্দ্রের সেপাই ছাড়া নেতাদের কাজ করা মুশকিল। লোকসভা ভোটের পর দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। ওইসব নেতাদের আর বিপদের ভয় নেই। তাই তাদের পিছন থেকে সরিয়ে নেওয়া হল কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা। অসুবিধে তো কিছু নেই। দিল্লিতে খুঁটির জোরে এই মহামান্যদের পাহারার বন্দোবস্ত করা হবে আমার আপনার ট্যাক্সের টাকায়। আবার দরকারে তা তুলেও নেওয়া হবে, যখন যেমন প্রয়োজন। বেশ ভালো ব্যাপার কিন্তু।