আজ থেকে শুরু হয়েছে হুগলির জাঙ্গিপাড়া ব্লকের ফুরফুরা শরীফে ” ইসালে সওয়াব “। প্রতি বছরের ন্যায় ২১,২২, ২৩ শে ফাল্গুন অনুষ্ঠিত হয় এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান। হিন্দু ও মুসলিমদের এই মহামিলন ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে বহু অগণিত ভক্তরা আসেন এই মহামিলন ক্ষেত্র ফুরফুরা শরীফে। সমাজ সংস্কারক ফুরফুরা শরীফের পীর আবুবকর সিদ্দিকীর মরদেহ সমাধিস্থ করা রয়েছে এই ফুরফুরা শরীফে। তাঁর এই সমাধিস্থল ফুরফুরা শরীফে বাংলাদেশ সহ ভিন রাজ্য থেকে ভক্তরা আসে। যদিও এই বছর বাংলাদেশ থেকে ভক্তরা আসতে পারেননি বলে জানা গেছে। ফুরফুরা শব্দের অর্থ হচ্ছে ” পূর্ন আনন্দ “। ধর্মীয় আলোচনার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে এখানে নিজেদের আত্মশুদ্ধি করে ভক্তরা। প্রতিদিন নিয়ম করে হয় নামাজপাঠ হয় এখানে। এই উৎসবকে ঘিরে বসে মেলাও। ধর্মীয় বই থেকে বিভিন্ন খাবারের দোকান বসে ফুরফুরায়। এই বছর রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্লাস্টিক বর্জন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে এই মেলায়। সেইজন্য সরকারী উদ্যোগে কাগজের ব্যাগ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে।
এই ফুরফুরা দরবার শরিফ বা সিলসিলা-ই-ফুরফুরা শরীফ বা ফুরফুরা মাজার শরীফ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার একটি ইসলাম ধর্মীয় দরবার শরীফ ও আত্ন্যাধিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। সাধারণ শ্রুতি রয়েছে, এটি রাজস্থানের আজমির শরীফের পরেই দেশের দ্বিতীয় সবচেয়ে সন্মানিত ও উল্লেখযোগ্য মাজার। এই মাজারটি হুগলি জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার জাঙ্গিপাড়া সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের ফুরফুরা গ্রামে অবস্থিত। এই মাজার শরীফটি উপমহাদেশের মুসলিমদের নিকট পবিত্র ও সন্মানিত স্থান। ইসালে সওয়াব মাহফিলের সময়ে এটি প্রচুর সংখ্যক ধার্মিক মানুষদের আকৃষ্ট করে।
১৩৭৫ সালে মুকলিশ খানের নির্মিত মসজিদ কেন্দ্র করে এই দরবার শরীফের যাত্রা শুরু হয়। মৌখিক রীতি অনুসারে ১৩৫০ সালের দিকে বাগদি (বার্গা ক্ষত্রিয়) রাজা এখানে রাজত্ব করত। রাজত্বকালে শাহ কবির হালিবি ও করমুদ্দিন নামে দুই মুসলিম সৈন্য এই ক্ষত্রিয় রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত করে, উভয় দলনেতাই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল।তাদের সমাধি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিকট খুব পবিত্র হিসেবে বিবেচিত।
ফুরফুরা গ্রামের অস্তিত্ব বহু পূর্ব থেকে থাকলেও এই দরবার প্রতিষ্ঠা করেন পীর আবু বকর সিদ্দিকী, তিনিই মূলত তিনি সিলসিলা-ই-ফুরফুরা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকে হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ বলা হয়। আনুমানিক ১৯০০ সালের দিকে এই দরবার প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমানে এই দরবার শরীফের মূল ব্যক্তিত্ব হচ্ছে পীর আবু বকর সিদ্দিকী ও তার পাঁচ ছেলে। পীর আবু বকর সিদ্দিকী ছিলেন একজন সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারক, তাকে মোজাদ্দেদ জামান বা যুগের সমাজ সংস্কারক বলা হয়। তিনি দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা, চিকিৎসা কেন্দ্র, মাদ্রাসা, বিদ্যালয় ও শিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি নারী শিক্ষায় অবদান রেখেছিলেন। তিনি সিদ্দিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে ফুরফুরা শরীফে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সিদ্দিকী সামাজিক অপরাধ দূর করার লক্ষ্যে বহু সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন, এসব কাজের মধ্যেই সমস্ত জীবন ব্যয় করেছেন তিনি।
আবু বকর সিদ্দিকী একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ছিলেন, ফুরফুরা শরিফের মাদ্রাসা দরিদ্র ছাত্রদের তিনি বিনা মূল্যে বা অতি সামান্য মূল্যে বোর্ডিং সুবিধা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। তিনি অনেক ইসলামি পত্রিকা এবং সংবাদপত্রের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছেন, পত্রিকাগুলোর মধ্যে সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা মুসলিম হিতৈষি অন্যতম। পীরের তৈরি মাদ্রাসা একসময় পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বিদ্যাকেন্দ্রে পরিণত হয়, পূর্ববঙ্গের প্রসিদ্ধ ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবর্তক হাজী শরীয়তুল্লাহ ফুরফুরাতে এসে আরবি ও ফার্সী ভাষা শিক্ষাগ্রহণ করেন।
এই দরবারের সব কার্যক্রমের মধ্যে উরসের মেলা সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণীয় বিষয়। এই মেলায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে থাকে, মেলাটি ফুরফুরা শরীফের মেলা বা দাদাপীরের উরস উৎসবের মেলা নামে পরিচিত। তবে আবু বকর সিদ্দিকী এই ধর্মীয় সমাগমের নাম দিয়েছিলো ইসালে সওয়াব। প্রতিবছর বাংলা বর্ষপঞ্জির ফাল্গুন মাসের ২১, ২২ ও ২৩ তারিখে (ইংরেজি মার্চ মাসের ৫, ৬ ও ৭ তারিখ) এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।এই সময় মেলায় মুরিদান গানের শিক্ষা চলে, মেলায় খেলাফত প্রাপ্ত আলেমগণ মুরিদদের দাদাপীরের সিলসিলা মতে ইসলামি জ্ঞানের দীক্ষা দান করেন। ফুরফুরা শরীফের মসজিদ প্রাঙ্গণে সন্ধ্যায় একসাথে কয়েক লক্ষ মানুষের উপস্থিতি হয়। উৎসবের দিনে পীরের মূল মাজার ও মেলার দেড়-মাইল দূর থেকে মানুষজনের ভিড় শুরু হয়। বিভিন্ন ধরনের দোকান, খাদ্যসামগ্রী, মাথার নক্সাদার টুপি, তসবী, চা-পান-মিষ্টির বাজার বসে। এই মেলা গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছে।