দীর্ঘ এক যুগের অপেক্ষার পর আবারও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির গৌরব অর্জন করল ভারত। দুবাইয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে পরাজিত করে রোহিত শর্মার নেতৃত্বাধীন দল ইতিহাসের পাতায় নতুন অধ্যায় যুক্ত করল। যদিও কিউইরা শুরুতে লড়াই করেছিল, শেষ পর্যন্ত ভারতীয় দল তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নেয়।
পুরনো আক্ষেপ মুছে ভারতীয় ক্রিকেট নতুন যুগের সূচনা করল রোহিত শর্মার নেতৃত্বে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে দাপুটে জয় তুলে নিয়ে দল গড়ে তুলল এক গর্বের মুহূর্ত। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভারতের হাতে উঠল এই মর্যাদাপূর্ণ শিরোপা, যা একসময় অধরা ছিল।
মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে এটি ভারতের দ্বিতীয় আইসিসি শিরোপা জয়। গত বছরের জুনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফি ঘরে তোলার পর এবার তারা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মুকুটও জয় করল। নতুন কোচ গৌতম গম্ভীরের জন্যও এটি এক বিশাল অর্জন, প্রথমবার জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়েই তিনি দলকে বিশ্বসেরা করে তুললেন।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পুরো টুর্নামেন্টে টস যেন রোহিত শর্মার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একবারও ভাগ্য তার পক্ষ নেয়নি, ফাইনালেও না। একদিনের ক্রিকেটে এমন ধারাবাহিকভাবে টস হারা সত্যিই বিরল ঘটনা। তবে এতে দলের মনোবল বা পারফরম্যান্সে কোনো প্রভাব পড়েনি। ব্যাট ও বল হাতে ভারতীয় দল ছিল অবিচল এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যার ফলশ্রুতিতে তারা ট্রফি ঘরে তুলতে সক্ষম হয়।
নিউজিল্যান্ডের ইনিংস শুরুটা ছিল দারুণ। রাচিন রবীন্দ্র ও উইল ইয়াং শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে খেলতে থাকেন। বিশেষ করে ভারতীয় পেসার শামি ও হার্দিক পান্ডিয়াকে তাঁরা শুরুতে সহজেই সামাল দেন। তবে রোহিত শর্মা দ্রুত পরিস্থিতি বুঝে কৌশল বদলান এবং পাওয়ার প্লের মধ্যেই স্পিন আক্রমণ এনে কিউই ব্যাটিং লাইনআপকে চাপে ফেলে দেন।
বরুণ চক্রবর্তী প্রথম ওভারেই সুযোগ তৈরি করলেও শ্রেয়স আয়ার ক্যাচ ফেলে দেন। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি, উইল ইয়াংকে আউট করে নিউজিল্যান্ডের প্রথম ধাক্কা দেন বরুণ। এরপর ৩৪ রানে গ্লেন ফিলিপ্সের উইকেটও শিকার করেন তিনি। তার ১০ ওভারের স্পেলে মাত্র ৪৫ রান দিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নেন।
ভারতের স্পিনারদের দাপটের সামনে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং ধসে পড়ে। কুলদীপ যাদব নিজের ঘূর্ণির জাদুতে রাচিন রবীন্দ্রকে ৩৭ রানে বোল্ড করেন, এরপর নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনকে মাত্র ১১ রানে ফেরান। তার এই দুই আঘাতে একঝটকায় ম্যাচের গতিপথ বদলে যায়, ভারতীয় দল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় খেলা।
অন্যদিকে, একপ্রান্তে উইকেট পড়তে থাকলেও ড্যারিল মিচেল লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ধীরস্থির ব্যাটিং করে ৯১ বলে অর্ধশতরান পূর্ণ করেন তিনি, যা নিউজিল্যান্ডকে কিছুটা আশা দেখায়। তবে বড় ইনিংস খেলার আগেই শামির শিকার হয়ে ৬৩ রানে বিদায় নেন, আর কিউইদের ব্যাটিং বিপর্যয় আরও গভীর হয়ে যায়।
মাইকেল ব্রেসওয়েল নিউজিল্যান্ডকে লড়াই করার মতো রান এনে দেন। মাত্র ৪০ বলে ৫৩ রানের দারুণ ইনিংস খেলে দলকে ৭ উইকেটে ২৫১ রানে পৌঁছে দেন। যদিও এটা খুব বড় সংগ্রহ ছিল না, কিন্তু লড়াই করার মতো রান তোলার কৃতিত্ব নিউজিল্যান্ডের ব্যাটারদেরই দিতে হবে।
স্পিনাররা দারুণ পারফর্ম করলেও ভারতের পেসাররা ব্যর্থ হন। শামি ৯ ওভারে ৭৪ রান দিয়ে মাত্র ১ উইকেট পান, আর হার্দিক ৩ ওভারে ৩০ রান খরচ করেও কোনো উইকেট পাননি। দুই পেসার মিলিয়ে ১২ ওভারে ১০৪ রান দেন!
ভারতের ফিল্ডিং এদিন বেশ হতাশাজনক প্রমাণিত হয়। ম্যাচ জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটি ক্যাচ ফেলে দেন ভারতীয় খেলোয়াড়রা, যার মধ্যে রোহিত শর্মা, শ্রেয়স আয়ার, শুভমন গিল এবং মহম্মদ শামির ভুল ছিল বিশেষভাবে গণ্য। এই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় নিউজিল্যান্ডের ব্যাটাররা বাড়তি রান সংগ্রহের সুযোগ পেয়ে যায়, যা তাদের দলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ স্কোরের দিকে এগিয়ে দেয়। ভারতের ফিল্ডিং যদি আরও নিখুঁত হতো, তবে ম্যাচের গতিপথ আরও সহজ হতে পারত।
জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে রোহিত শর্মা শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে খেলতে থাকেন। ইনিংসের প্রথম বলেই তিনি দৃষ্টিনন্দন ছক্কা হাঁকান, যা ভারতের আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিংয়ের ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে, নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক মিচেল স্যান্টনার শুরুতেই মূলত পেসারদের দিয়ে বেশি ওভার করানোর সিদ্ধান্ত নেন। তার এই কৌশল ভারতীয় ব্যাটারদের জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে, কারণ তারা পেস বোলিং সহজেই সামলাতে সক্ষম হন এবং শুরু থেকেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেন।
রোহিত নিজের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি অর্ধশতরান দ্রুতই তুলে নেন, তবে ব্যক্তিগত ৭৬ রানে রাচিন রবীন্দ্রর শিকার হয়ে সাজঘরে ফিরতে হয় তাকে। অন্যদিকে, শুভমন গিলও স্বচ্ছন্দে ব্যাট করছিলেন, কিন্তু গ্লেন ফিলিপ্সের অবিশ্বাস্য ক্যাচে তার ইনিংস শেষ হয়ে যায়।
ভিরাট কোহলির ওপর বড় প্রত্যাশা থাকলেও তিনি সেই আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি। মাত্র ১ রান করে মাইকেল ব্রেসওয়েলের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফেরেন। কোহলির দ্রুত বিদায়ের পর ভারত কিছুটা চাপে পড়ে, এবং রোহিতও আউট হয়ে গেলে ম্যাচে ফেরার চেষ্টা করে নিউজিল্যান্ড।
এই সুযোগে কিউইরা আরও আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং করতে থাকে। ভারতীয় ব্যাটারদের প্রতিটি রান নিতে সংগ্রাম করতে হয়।
ভারত যখন চাপে, তখন শ্রেয়স আয়ার ও অক্ষর পটেল দায়িত্ব নিয়ে ইনিংস গড়তে থাকেন। দুজন ধৈর্য ধরে ব্যাট চালিয়ে ৬১ রানের গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়েন। তবে শ্রেয়স ৪৮ রানে ফিরলে ম্যাচ আবার উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে।
শেষ ওভারে ম্যাচ জমে উঠলেও দৃঢ় মানসিকতায় দলকে জয়ের দোরগোড়ায় নিয়ে যান লোকেশ রাহুল ও হার্দিক পান্ডিয়া। শুরুতে ধৈর্য ধরে খেলার পর নিউজিল্যান্ডের স্পিন আক্রমণ শেষ হতেই তারা পেসারদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। শেষ মুহূর্তে রবীন্দ্র জাডেজার ব্যাট থেকে আসা চতুর্থ রানই নিশ্চিত করে ভারতের ঐতিহাসিক জয়।
মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে দুটি আইসিসি ট্রফি তুলে নিলেন রোহিত শর্মা, প্রমাণ করলেন তার নেতৃত্বের দক্ষতা। নতুন কোচ গৌতম গম্ভীরও প্রথমবার দায়িত্ব নিয়েই ভারতকে বিশ্বজয়ের স্বাদ দিলেন। এই জয় শুধু ট্রফি জয়ের নয়, এটি ভারতীয় ক্রিকেটের আত্মবিশ্বাসী নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে পুরনো ব্যর্থতার জবাবও রয়েছে, ভবিষ্যতের দিকেও তাকিয়ে থাকার কারণও রয়েছে।
Leave a comment
Leave a comment