এই কমিউনিস্ট আন্দোলনের পার্টি কংগ্রেস একটা বড় ব্যাপার। কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রত্যেক শরিক এই পার্টি কংগ্রেসকে বেশ গুরুত্ব দেয়। এই পার্টি কংগ্রেসে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হয়। সর্ব ক্ষেত্রে সব পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে বিচার বিবেচনা করে দলের রাজনৈতিক লাইন ও কৌশলগত লাইন ঠিক করা হয়। একটা সময় এই দুই লাইন ছিল একে অপরের পরিপূরক। মানে দলের কৌশলগত লাইন হতো মূল রাজনৈতিক লাইনের অনুসারী। তার লক্ষ্য হোল আগামী দিনে সামগ্রিক পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে দেশ তথা শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষা ও অগ্রসর করতে সংগ্রাম- আন্দোলনকে এক উন্নত উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া। যে উচ্চতায় শাখা থেকে অঞ্চল, জেলা ও রাজ্য থেকে জাতীয় স্তরে চলে মন্থন। নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত, এমন কি বাইরেও, আলোচনা হয় ‘খসড়া’ রাজনৈতিক দলিল। মতামত ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ভিত্তিতে পার্টি কংগ্রেসে আলোচনার পর সেটা চূড়ান্ত করা হয়। এই পদ্ধতি দীর্ঘকাল চলছে প্রতি ৩ বছর অন্তর, অবশ্য সিপিআই এম এল লিবারেশন করে ৫ বছর অন্তর। খুবই গণতান্ত্রিক ও বিজ্ঞানসম্মত এই পদ্ধতি, সন্দেহ নেই, অন্য কোন রাজনৈতিক দলে আছে কিনা ঠিক জানা নেই। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নানা আবিস্কার সমাজ ও নানা বিধি-ব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়ে থাকলেও আন্দোলনের ধারা, সাংগঠনিক নীতির ক্ষেত্রে বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটেনি।

সিপিএম-এর ২৪তম পার্টি কংগ্রেস মাদুরাইয়ে হচ্ছে। ডকুমেন্ট বেরিয়েছে। আলোচনা চলছে। কংগ্রেস এর প্রস্তুতিতে রাজ্য সম্মেলন হয়ে গেল। বেশ কিছুটা দূরত্বে রয়েছে সিপিআই-এর ২৫ তম পার্টি কংগ্রেস। এক সময়ে এই দুই দলের পার্টি কংগ্রেস পাশাপাশি হতো বেশ গুর গম্ভীর ব্যাপার এই পার্টি কংগ্রেস। নানা দেশের প্রতিনিধিরা দুটো কংগ্রেসেই আসতেন। আজ আর সেসবের পাট নেই একদম। আসে শুধু শুভেচ্ছা-বার্তা। ৩ দশক হোল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর থেকে এই অবস্থা। অবশ্য এখনও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ থেকে কমিউনিস্ট/ওয়ার্কার্স পার্টির ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিনিধিরা অনেক ঝঞ্ঝাট পুঁইয়ে সিপিআই ও সিপিএম কংগ্রেসে আসার চেষ্টা করেন। এটাও কমিউনিস্ট ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক দলে দেখা যায় না। অনন্যতা ও ভিন্নতা আজ অনেকটা মলিন হলেও সেই একধারা বহাল আছে আজও এই বামেদের পার্টি কংগ্রেসে।

অস্বীকার করার কোন যায়গা নেই দুনিয়াটা দারুণ রকম, সব অনুমান ও ভাবনার বাইরে, বদলে গেছে। ধান্দা-পূঁজি আর সামরিক হাতিয়ারের জোরে দুনিয়াকে দক্ষিণপন্থীরা তাদের অনুকুলে অনেকটাই বদলে নিয়েছে নিজেদের কুক্ষিগত করে নিয়েছে। দেশটাও একই পদ্ধতিতে আমূল বদলেছে দ্রুত হারে। ক্রমাগত বদলেছে। কিছু দেখা গেছে। আর অনেকটাই দেখা যায় নি। দেশ-দুনিয়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক তথা গণতান্ত্রিক আন্দোলন অনেকটাই দুর্বল হয়েছে আজ। এই দুর্বল হওয়ার পেছনে শরিকদের নিজেদের একটা ভূমিকা আছে। ত্রুটি আছে। এটা স্বীকার না করলে এগোন কঠিন। পার্টি কংগ্রেস, সিপিএম, সিপিআই বা সিপিআই-এমএল লিবারেশন বা অন্য যারই হোক প্রকাশিত ‘ডকুমেন্ট’ নিয়ে আলোচনা করা, খোলাখুলি মতামত দেওয়ায় অসুবিধে কোথায়! কিন্তু সেখানেও এতদিন পরেও এই দ্রুত বদলে যাওয়া দুনিয়ায় এখনও কত না লুকোচুরির আশ্রয় নেওয়া আর গোপনীয়তা।

সিপিএম-এর পলিটিক্যাল ড্রাফট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এটা ভালো। কে বলছেন নয়, আরও কী বলা হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনায় অসুবিধে কোথায়? আলোচনা হচ্ছে বর্তমান শাসক দলের ‘শ্রেণি চরিত্র’ কী, ফ্যাসিস্ট, নিও-ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিস্টিক কোনটা ঠিক তা নিয়ে। দলের পক্ষ থেকে একটা ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের শরিকদের মধ্যে নানা মত থাকা সত্ত্বেও মতাদর্শগত প্রশ্নে বিজেপি-আরএসএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কমিউনিস্টরাই একমাত্র বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য শক্তি – এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। তাই মতাদর্শগত প্রশ্নে বিতর্ক বিরোধ আর উন্মুক্ত বা জিইয়ে না রেখে, ইস্যুগুলো চিহ্নিত করে নিদেনপক্ষে সহমতে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে একটা চেষ্টা করা।
বিজেপি-আরএসএস এর বিরূদ্ধে সবাইকে একসাথে নিয়ে লড়াই এর ময়দানে নেমে পড়া। কিন্তু সেই উদ্যোগ কোথায়। যে বিজেপির কর্মকাণ্ডে দেশটা ইতিমধ্যে পিছিয়ে গেছে প্রায় ১০০ বছর বলে অভিযোগ করে বাম ঐক্যজোট, কংগ্রেসও। তারা সবাই বলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ভিত্তি, – ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরম্পরা, মূল্যবোধ, বৈচিত্র, সম্প্রীতি, ঐক্য, সংহতি। বিপন্ন হয়েছে মানুষের জীবন, জীবিকা, গণতান্ত্রিক অধিকার, সামাজিক সুরক্ষা থেকে ন্যুনতম প্রয়োজন – অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, আর স্বাস্থ্য। আক্রান্ত বিজ্ঞান-চেতনা ও পরিবেশ ভাবনা। যত দ্রুত সম্ভব এইসব ছিদ্রপথ বন্ধ হওয়া দরকার। কমিউনিস্টরা ছাড়া এর গুরুত্ব আর কারও বোঝার কথা কি? একটার জন্যে আর একটা অপেক্ষা করতে পারে না। বিজেপি-আরএসএস-এর কর্মকাণ্ড ঠেকাতে দেশব্যাপী রাস্তায় লড়াই-আন্দোলনে নামতে ন্যুনতম বিকল্প কর্মসূচী তৈরি বর্তমান সময়ের একমাত্র রাজনীতি। একে শক্তপোক্ত করে গড়ে তোলা দরকার। কিন্তু আদৌ সেটা হচ্ছে কী? যে কর্মসূচী গ্রহণ করে এই বিজেপি আর আর এস এস এর মোকাবিলা করা যাবে সারা দেশজুড়ে। বামদের রাজনৈতিক পার্টির লাইন ঠিক করা এই পার্টি কংগ্রেসে সেই সব কর্মসূচী গ্রহণ করার কথা লিপিবদ্ধ হচ্ছে তো। নাকি শুধুই পার্টি কংগ্রেস আর তার গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়েই জোর আলোচনা তর্ক বিতর্ক হয়েই শেষ হচ্ছে এই অমূল্য আলোচনা।

নির্বাচন’ তো একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম। কিন্তু তাই এখন হয়ে উঠেছে ‘রাজনীতি’। সব কিছুই বিবেচিত হয় নির্বাচন তথা ভোট বা আসনের নিরিখে। এই নির্বাচনে বামেদের প্রাপ্তি শুণ্য। লাভ বিজেপি ও টিএমসি উভয়ের। কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীরা যদি এক রাজনীতির ভিত্তিতে একজোটে এক কৌশলে সর্বত্র লড়েন তাহলে অসুবিধে কোথায়? পশ্চিম বাংলায়? ১৯৬৭ সালের কথা মনে পড়ে। সেবারে বামপন্থীরা কংগ্রেসকে পরাস্ত করতে একমত হতে পারে নি। সিপিআই ‘এক শত্রু–দুই ফ্রন্ট’ কৌশল নিয়ে লড়েছিল। আহ্বান জানিয়েছিল কংগ্রেসকে পরাস্ত করুন। ‘আমাদের যদি ভোট না দেন তবে কংগ্রেসকে নয়, অপর ফ্রন্টকে ভোট দিন’ আহ্বান জানিয়েছিল। কংগ্রেস পরাস্ত হয়েছিল। ভোটের পরে দুই ফ্রন্ট মিলে এক ফ্রন্ট সরকার গড়েছিল। এই হোল নতুন রাজনীতির নির্মাণ যা রাজ্যের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন করে দিয়েছিল। সেটা ভুলে গেলে হবে কেন! তাহলে এই পার্টি কংগ্রেসে সেই পুরোনো দিনের লড়াই এর কথা স্মরণ করে এক হয়ে লড়তে আপত্তি কোথায়
এত আলোচনা, হিসেব নিকেশ বাছবিচার ওজর আর আপত্তি কেনো। যখন শ্রেনী শত্রু চিহ্নিত হয়েই গেছে।
আবার সামনেই আসছে নির্বাচন। ২৯৪ টি আসন। তার মধ্যে ৭৭টি আসন বিজেপি’র দখলে। বামপন্থীরা শুণ্য! এই অবস্থায় সব আসনে লড়ে শুণ্য পাওয়ার চাইতে বিজেপি-কে পরাস্ত করতে বামপন্থীরা এই ৭৭ টা আসনে এককাট্টা হয়ে জয় সুনিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে লড়ুক। আর বাকি ২১৭ টা আসনে সেখানেও বামপন্থীরা বিজেপি-র পরাজয় সুনিশ্চিত করতে প্রার্থীদের নির্বাচনে দাঁড় করাক। আর তাতেই এই বিজেপি আর টিএমসির যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাকে কিছুটা হলেও প্রতিহত করা যাবে। মুখোশ খুলে পড়বে বিজেপি আর তৃণমূলের। আর তাতেই এই পার্টি কংগ্রেস, পার্টি লাইন ঠিক করা, রাজনৈতিক দলিল, খসড়া অনুমোদন করা আর গুরু গম্ভীর আলোচনা সবকিছুই ঠিক পথে এগোবে। ভোটের রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশকে আটকে দিয়ে শুধুই মানুষের ন্যুনতম দাবি রুটি, রুজি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, সুরক্ষা, অধিকার রক্ষা ও প্রসার, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং পরিবেশ রক্ষা – সেসব দাবিতে একটা বছর ধরে রাস্তায় চলুক লাগাতার লড়াই-আন্দোলন। বিকল্প নির্মাণের আন্দোলন। আর তাহলে বাকিটা মানুষই বুঝে নেবে। আর তাহলেই হবে এই পার্টি কংগ্রেসের সার্থকতা।