কখনো রাজ্যে বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ছিল মোট ৭৭। তবে সেই ৭৭-এর মধ্যে দু’জন ছিলেন বর্তমান সাংসদ, যাঁরা বিধানসভা নির্বাচনে জয় পেলেও রাজনৈতিক সমীকরণ বুঝে ইস্তফা দেন। ফলে প্রথম ধাক্কাতেই বিধায়ক সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৭৫-এ।
পরবর্তী সময়ে আটজন বিধায়ক বিজেপি ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেন, একজনের মৃত্যু হয়, এবং আরেকজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেন। যে আসনগুলো শূন্য হয়েছিল, সেগুলোর উপনির্বাচনে বিজেপি একটিতেও জয় লাভ করতে পারেনি। ফলে দলটির বর্তমান বিধায়ক সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৫-তে।
তবে কি বিজেপি এখন স্বস্তিতে? দলের ভিতরের খবর, আরও আটজন বিধায়কের রাজনৈতিক অবস্থান অনিশ্চিত, যা দলীয় নেতৃত্বের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলেছে।
সাম্প্রতিক ঘটনায়, হলদিয়ার বিধায়ক তাপসী মণ্ডল বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এটি কেবল একজন বিধায়কের দলত্যাগ নয়, বরং শুভেন্দু অধিকারীর শক্ত ঘাঁটিতেই এই ধাক্কা এসেছে, যা বিজেপির জন্য বাড়তি অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূলও এটিকে তাদের কৌশলগত জয় হিসেবে তুলে ধরছে। তবে এই অস্থিরতা শুধু হলদিয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই—উত্তরবঙ্গ, রাঢ়বঙ্গ ও মতুয়া অধ্যুষিত এলাকাতেও দলের ভেতরে টানাপোড়েন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
উত্তরবঙ্গের কার্শিয়ঙের বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশ্যে দলের অবস্থানের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তাঁর দাবি, বিজেপি পাহাড়বাসীদের ‘বিশেষ মর্যাদা’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রাখেনি, যা তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। শুধু তাই নয়, তিনি সরাসরি পৃথক রাজ্যের দাবিও তুলেছেন, যা দলের নীতির বিপরীত। এই অবস্থানে দলীয় নেতৃত্ব অসন্তুষ্ট হলেও, বিষ্ণুপ্রসাদ নিজের অবস্থান থেকে সরেননি এবং প্রয়োজনে দল ছাড়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
যদিও তৃণমূলে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ তাঁদের নীতিও পাহাড়কে আলাদা রাজ্য করার পক্ষপাতী নয়।
কালিয়াগঞ্জের বিধায়ক সৌমেন রায়ের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বারবার ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। কখনও তিনি বিজেপির শিবিরে, তো কখনও তৃণমূলে নাম লেখাচ্ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তাঁর মূল আনুগত্য কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতি নয়, বরং রাজবংশী নেতা অনন্ত মহারাজের ওপর নির্ভরশীল। অনন্ত মহারাজ বিজেপির সঙ্গে থাকবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়, আর সেই অনিশ্চয়তা সৌমেনের অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তিনি বিজেপির টিকিটে জয়ী হলেও পরে তৃণমূলে চলে যান। তবে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনি আবার বিজেপিতে ফিরে আসেন, যা তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে জল্পনা সৃষ্টি করেছে।
এদিকে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের নিজের জেলাতেই এক বিধায়ক অভিযোগ তুলেছেন যে, পরিকল্পিতভাবে তাঁকে হারানোর চেষ্টা চলছে। তাঁর এই মন্তব্য নতুন করে দলবদলের গুঞ্জন বাড়িয়েছে।
নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার মতুয়া অধ্যুষিত এলাকায় বিজেপির অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। এই অঞ্চলের তিন বিধায়ক দলত্যাগের বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা করছিলেন, তবে লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি তাঁদের মধ্যে দু’জনকে প্রার্থী করে দলবদল ঠেকানোর চেষ্টা করে। যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁরা নির্বাচনে পরাজিত হন, তবু বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, ভোটের আগে দল ছাড়লে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারত। এদিকে, একই অঞ্চলের আরেক বিধায়ক লোকসভা নির্বাচনের সময় হঠাৎ করেই নিজের পরিবার ও ঘনিষ্ঠ মহল থেকে দূরত্ব তৈরি করেন। তখন রাজনৈতিক মহলে জল্পনা ছড়ায়, তিনি হয়তো দল বদলের চিন্তাভাবনা করছেন। এই গুঞ্জন রুখতে বিজেপির এক প্রবীণ নেতা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হন। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, এই অঞ্চল নিয়ে দলের উদ্বেগ ততই বাড়ছে।
করেছিলেন, তখন গুঞ্জন ওঠে যে তিনি তৃণমূলে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি সামলাতে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।
রাঢ়বঙ্গেও বিজেপির রাজনৈতিক অস্থিরতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দলের দুই বিধায়ক নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। একজন একসময় বামফ্রন্টের টিকিটে জিতেছিলেন, কিন্তু বর্তমানে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর ভালো-মন্দ নিয়ে মন্তব্য করছেন, যা তাঁর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তিনি প্রকাশ্যে বলছেন, “দল কখনও খারাপ হয় না, কিন্তু কিছু নেতা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে।” অন্যদিকে, আরেকজন বিধায়ক বেশ কয়েকটি নির্বাচনে বিজেপির হয়ে লড়লেও দলের প্রতি তাঁর আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ায় তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরিকল্পনা শুরু করতে চাইলেও, বিজেপি এখনই অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখে। বিধায়কদের দলত্যাগ ও অসন্তোষ সামলানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত, হলদিয়ার বিধায়ক তাপসী মণ্ডলের দলত্যাগের পর দলের অন্দরে উদ্বেগ বেড়েছে। ইতিমধ্যে আটজন বিধায়কের ভূমিকা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে, যা দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নতুন জটিলতা তৈরি করছে।
Leave a comment
Leave a comment