লগ্নজিতা চক্রবর্তী সবসময়ই সাহসী মন্তব্যের জন্য পরিচিত। নারীদের প্রতি সমাজের অন্যায় আচরণ, বিশেষ করে তাঁদের শারীরিক কষ্টকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে, নারীদের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও বাস্তবে তাঁদের চলার পথ আজও কাঁটাযুক্ত। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই বাধাগুলোর বড় অংশই আসে নারীদেরই কাছ থেকে। অথচ, এই নারীরাই যুগের পর যুগ পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের শিকার হয়ে এসেছেন।
নারীদের পথচলার সবচেয়ে বড় বাধা তৈরি হয় তাঁদের নিজস্ব পরিবার থেকেই। মায়েরা, শাশুড়িরা, কাকিমারা—অজান্তেই বহু পুরনো সামাজিক বিধিনিষেধকে টিকিয়ে রাখেন, কারণ তাঁরাও একসময় এই একই নিয়মের শিকার ছিলেন। লগ্নজিতা মনে করেন, সময় পাল্টালেও চিন্তাধারার পরিবর্তন খুব ধীরগতিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, “আজ আমি নির্ভয়ে নিজের কথা বলতে পারছি, কিন্তু আমাদের মায়েদের সময়ে সেটা সহজ ছিল না। তখন তাঁরা নিজেদের মতামত জানালেও, বেশি দূর এগোতে পারেননি। এখনো সমাজ মেয়েদের শেখায়, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে, অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন তোলা হয় না। সংসারে কোনও সমস্যা হলে প্রথমেই মেয়েটির দিকেই অভিযোগের আঙুল তোলা হয়, যেন ভুল করার অধিকার কেবল তারই রয়েছে।”
সমাজের বদ্ধধারণা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গিয়ে লগ্নজিতা বলেন, “একজন মেয়ে যদি শ্বশুরবাড়িতে কোনও সমস্যার সম্মুখীন হয়, তবে বেশিরভাগ মানুষ ধরে নেন, সে হয়তো ‘বড্ড বেশি নিজের মতো চলতে চায়’। কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেছে, যদি কেউ প্রতিবাদ না করত, তাহলে সমাজে এত পরিবর্তন আসত কি? আজ আমরা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারছি, কারণ একসময় কেউ এই বিষয়ে ভাবার সাহস দেখিয়েছিল, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিল।”
পরিবর্তন আনতে গেলে কেবল আপোস করলেই চলে না, কখনও কখনও লড়াই করাও জরুরি। লগ্নজিতা এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দেন, “একসময় মহিলাদের ‘স্তন কর’ দিতে হতো, আর তা দিতে ব্যর্থ হলে ভয়ঙ্কর শাস্তির মুখে পড়তে হতো। কিন্তু কেউ একজন এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই আজ সেই নিষ্ঠুর প্রথা অতীত হয়েছে। তবে সেই পরিবর্তন সহজে আসেনি—সংগ্রাম করতে হয়েছে, রক্ত ঝরেছে। চুপচাপ মেনে নিয়ে বসে থাকলে কিছুই বদলায় না।”
সম্প্রতি ঋতুস্রাবকালীন ছুটি দেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে নানা বিতর্ক চলছে। অনেকেই মনে করেন, এই ছুটির প্রয়োজন নেই। কিন্তু লগ্নজিতা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানান, “আমি আগে কখনও ঋতুস্রাবের সময় বিশেষ অসুবিধা অনুভব করিনি, তাই বিষয়টি নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু আমার বহু বান্ধবী ছিলেন, যাঁরা এই সময় ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতেন। তখন তাঁদের কষ্টকে গুরুত্ব না দিয়ে ‘নাটক করছে’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হতো। অথচ, তিরিশের পর যখন আমিও সেই তীব্র ব্যথার সম্মুখীন হলাম, তখন বুঝলাম, এটি কতটা কষ্টকর! একজন পুরুষকে কি কখনও টানা তিন দিন সহ্য করার মতো যন্ত্রণা নিয়ে কাজ করতে হয়? তাহলে নারীদের এই যন্ত্রণাকে অবহেলা করা হবে কেন?”
নারী ও পুরুষের শারীরিক গঠনে প্রকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে, যা অস্বীকার করা যায় না। লগ্নজিতা মনে করেন, “আমার স্বামী শারীরিকভাবে আমার চেয়ে উচ্চতর ও শক্তিশালী, তাই সে সহজেই ভারী জিনিস বহন করতে পারে। কিন্তু শারীরিক ক্ষমতায় পার্থক্য থাকলেই তা যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না।”
Leave a comment
Leave a comment
