সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
‘মঁসিয়ে দৌরগা চরণ রাকুইট’ – চন্দননগরের স্ট্র্যান্ডে ঘাটের ওপর একটি ফলকে লেখা আছে এই নামটি। কী মনে হচ্ছে ? কোনো ফরাসী ব্যক্তির নাম ? একদমই না। এটি হল সেই মানুষটির নাম যাঁর নামে ঐ ঘাট, তিনি ‘দুর্গাচরণ রক্ষিত’। ভারতের প্রথম ‘লিজিয়ঁ দ্য অনার’ প্রাপক দুর্গাচরণ রক্ষিত। তাঁর স্মরণেই চন্দননগর স্ট্র্যান্ডে রয়েছে ঘাট।
এমনিতেই গঙ্গাধারের স্ট্র্যান্ড চন্দননগরের অন্যতম শোভাবর্ধনকারী একটি স্থান। আর সেখানকার দুর্গাচরণ রক্ষিত ঘাট তো ভ্রমণবিলাসীদের অন্যতম আকর্ষণ কেবল তার নান্দনিকতার কারণে। সেই দুর্গাচরণ রক্ষিতের নামই লেখা আছে ফরাসী উচ্চারণে। কিন্তু কে তিনি? তিনি আধুনিক চন্দননগরের অন্যতম রূপকার। উনবিংশ শতকের বাংলার অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ভূষিত হয়েছিলেন ‘লিজিয়ঁ দ্য অনার’ পদক-সম্মানে।
বাঙালী ব্যবসাবিমুখ – এই অপবাদকে সেই উনিশ শতকের শেষের দিকে মিথ্যে প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন এই বাঙালি। আমরা জানি, বাংলাব্যাপী ব্রিটিশ শাসনের মাঝেও চন্দননগর ছিল ফরাসী উপনিবেশ। উপযুক্ত ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত হওয়ার কারণে চন্দননগরে বাংলার নানা জায়গা থেকে মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকত। তেমনই ভাণ্ডারহাটির কায়স্থ রক্ষিত পরিবারও চন্দননগরের লালবাগানে এসে বসতি গড়েছিলেন। সেই কায়স্থ পরিবারেই ১৮৪১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জন্ম হয় দুর্গাচরণের।
চন্দননগরের লালবাগানে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষিতদের সুবিশাল বাসভবন (‘রক্ষিত ভবন’) দুর্গাচরণের একদা গৌরব ও সমৃদ্ধির পরিচয়বাহী। রক্ষিত পরিবারের ছিল ব্যবসা। তবে, সে ব্যবসা ছিল ছোট আকারের। আর মাত্র দশ বছর বয়সে পিতৃহারা দুর্গাচরণ পারিবারিক দায়িত্ব পালনের কারণে চাকরি নেন ‘ক্যামা সাহেবের কোম্পানি’তে। সেখানেই শেখেন পণ্য আমদানি-রপ্তানির খুঁটিনাটি। তবে চাকরি ঠিক তাঁর রক্তে ছিল না। অগত্যা কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে ফিরে এলেন পারিবারিক ব্যবসায়। প্রায় একার উদ্যমে হয়ে উঠলেন এক সম্ভ্রান্ত বিত্তশালী উদ্যোগপতি।
ফরাসডাঙার তাঁতকে অবলম্বন করে ছোট্ট ব্যবসাকেই আপন কর্মদক্ষতা, বুদ্ধি, নিখুঁত গাণিতিক জ্ঞান আর কঠোর পরিশ্রমের জোরে এক বিরাট উচ্চতায় নিয়ে গেলেন দুর্গাচরণ। সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে এল তাঁর নাম। ধীরে ধীরে তাঁত ছাড়াও অন্যবিধ নানা পণ্যের রপ্তানী শুরু করলেন তিনি। চাল, ডাল, চা, তিল, সরষে, পোস্তদানা, তিসি ও আফিম, তসরের থান ও কাটা কাপড় চন্দনননগর থেকে ফ্রান্স, মালয়শিয়া, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, জামাইকা, হংকং, মরিশাস ও মিশরের মতো দেশে রপ্তানি করতো দুর্গাচরণের জাহাজ। হ্যাঁ, তাঁর নিজস্ব জাহাজ। ব্যবসা এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে ব্যক্তিগত জাহাজ ক্রয় করতে হয়েছিল দুর্গাচরণকে। অন্যদিকে আমদানি করতেন হোয়াইট লেড, জিঙ্ক হোয়াইট, কুইনাইন, ফরাসি মদ৷ সারা ভারতে দুর্গাচরণের আমদানিকৃত পণ্যের কদর ছিল। সেই সময়ের ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মুখে সর্বাগ্রে উচ্চারিত হত দুর্গাচরণের নাম। আর্থিক প্রতিপত্তি এতটাই ছিল যে পরাধীন আমলেও কয়েকজন ব্রিটিশকে তিনি বিদেশে ব্যবসার জন্য নিজের অফিসে কাজ দিয়েছিলেন। এ ঘটনা নিতান্ত ব্যতিক্রমী তো বটেই, সে যুগে একপ্রকার অকল্পনীয় ছিল। সাহেবদের সাথে তিনি দেখা করার জন্য গড়ে তুললেন ‘সাহেবি বৈঠকখানা’। কলকাতায় চৌরঙ্গী অঞ্চলের ২৯ কাঠা জমির মালিক ছিলেন তিনি। কলুটোলার পাঁচতলা বাড়ি ও আরও অনেক সম্পত্তি তাঁর অসীম কৃতিত্বের সাক্ষ্য বহন করছে৷ তবে এত বিত্তের মাঝেও দুর্গাচরণ ভোলেননি তাঁর কষ্টের দিনের কথা। আর চন্দননগর ছিল তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়। তাই স্বপার্জিত সম্পদকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন চন্দননগর ও তাঁর সাধারণ মানুষের মঙ্গলার্থে। গরীব মানুষদের জন্য খুলে দেন বিনামূল্যে ঔষধের দোকান; ব্যবস্থা করলেন বিনামূল্যে চাল-ডাল প্রদানের। তাঁর শিক্ষক গোপালচন্দ্র দাসের সাহায্যে তিনি ‘একল দুর্গা’ নামের একটি ছেলেদের বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এটি ‘দুর্গাচরণ রক্ষিত বঙ্গবিদ্যালয়’ নামে পরিচিত।
১৮৮৩ সালে অবৈতনিক জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট পদের অধিকারী হন দুর্গাচরণ৷ তাঁর বিদ্যানুরাগের জন্য প্যারিসের ফরাসি সাহিত্য পরিষদ তাঁকে অর্পণ করে সম্মানিত সভ্যপদ। অবশেষে ১৮৯৬ সালের ৬ই জুন ফ্রান্স সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে প্রদান করা হল ‘লিজিয়ঁ দ্য অনার’। ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন প্রচলন করেছিলেন এই পদকটির। সাধারণ ভাবে আমরা জানি, সত্যজিত রায়ই ভারতে প্রথম এই সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। কিন্তু না ! দুর্গাচরণ রক্ষিতই হলেন প্রথম বাঙালি তথা প্রথম ভারতীয় যিনি ছিলেন ‘লিজিয়ঁ দ্য অনার’ প্রাপক৷
অনেকাংশেই আধুনিক চন্দননগরের প্রাণপুরুষ ছিলেন এই মানুষটি। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য সবক্ষেত্রেই চন্দননগরের উন্নতিকল্পে ব্যয় করেছিলেন অকাতরে। চন্দননগরের জোড়া-ঘাট, জেটি তাঁরই অর্থে নির্মিত। শেষ জীবনে ইচ্ছা ছিল একটি কারুকার্য শোভিত ঘাট তৈরী করবেন। তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ করেন পুত্র শ্যামাচরণ রক্ষিত। সেই ঘাটই বর্তমানে ‘দুর্গাচরণ রক্ষিত ঘাট’।