সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
বাংলার পরিষদীয় রাজনীতির দৈন্যতা ফের একবার প্রকাশ্যে আনলো সদ্য সমাপ্ত রাজ্য বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্ব। প্রকৃতপক্ষে জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়া জনপ্রতিনিধি বিধায়ক বিধানসভার সদস্য হন। আর যারা নেতাকে জনপ্রতিনিধি করে বিধানসভায় পাঠান এই মানুষগুলোর অভাব অভিযোগের কথা বিধানসভায় তুলে ধরাই হল একজন বিধায়কের প্রধান ও অন্যতম কর্তব্য। সে কারণেই ট্রেজারি বেঞ্চ নয় বিধানসভায় বিরোধী রাই মূল শক্তি বলে বিবেচনা করা হয়। কারণ জন উন্নয়ন থেকে গণতন্ত্র, মানুষের জন্য সরকারের পথ চলার দিকনির্দেশ করা সবকিছুতেই সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিকভাবে তর্ক-বিতর্ক, আলাপ-আলোচনার অন্যতম পিঠস্থান হল রাজ্য বিধানসভা। আজ সেই বিধানসভাতেই দিনের পর দিন দফা বাড়ি বাজেট অথবা বিভিন্ন ইস্যুতে আলাপ-আলোচনা বন্ধ হয়ে যাওয়া, আলোচনা না করে দিনের পর দিন বিরোধীদের লক আউট বা বিক্ষোভের রাজনীতি আখেরি গণতন্ত্রের মন্দির কে কলুষিত করছে বলে বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে। শাসক দল তো বটেই এমনকি বিরোধী বিজেপি এবার এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিধায়করাই। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সহ দলের চার বিধায়ক কে সাসপেন্স করার ইস্যুতে দিনের পর দিন শব্দ সমাপ্ত বাজেট অধিবেশন বয়কটের রাস্তায় হেঁটেছে বিরোধী শিবির। রাজ্য রাজনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইসুতে তারা আলোচনায় অংশই নেননি। যেখানে বিরোধী দলনেতা বিধানসভার বাইরে ও ভিতরে সমানভাবে তৃণমূল সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বা কাজ কর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন সঙ্গবদ্ধ করার কথা বলেন ঠিক সেখানেই বিধানসভার ভিতরে দিনের পর দিন বিরোধী শিবির অনুপস্থিত থেকে গণতন্ত্রের মহিমাকে অগ্রাহ্য করেছেন বলে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বিজেপির অন্দরেই। বিধায়কদের একাংশের দাবি, বিধানসভার বাইরে যেভাবে বিজেপি বিধায়করা দিনের পর দিন সোচ্চার হয়েছেন বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। ঠিক সেভাবেই বিধানসভার ভিতরেও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যুতে আওয়াজ তোলা উচিত ছিল বিরোধী বিধায়কদের। কিন্তু বয়কটের রাস্তায় হেঁটে মূলত ‘ফাঁকা মাঠে গোল’ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে শাসক দলকে। ফলে এটা শুধু পরিষদীয় রাজনীতির পরিপন্থী তাই নয় রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও বিধায়কদের একটি অংশের বক্তব্য, গত চার বছরে বিধানসভা অধ্যক্ষ সহ ট্রেজারি যেভাবে বিরোধীদের অসম্মান করেছে সে কথা বিধানসভার বাইরে জনসমক্ষে তুলে ধরা যথেষ্ট জরুরী। তাই বয়কটের রাস্তায় হেঁটে জনসমক্ষে আন্দোলন করাটাই যুক্তিযুক্ত। যদিও বিরুদ্ধপক্ষের মত, বিরোধী দলনেতা সহ বিধায়কদের সাসপেন্ড করা, বিরোধীদের মুলতবি প্রস্তাব খারিজ করা, রিজেরি বেঞ্চ থেকে নানা রকম রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত কটাক্ষ, মার্শাল ডেকে বিরোধী বিধায়ককে অধিবেশন কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া ইত্যাদি নানাবিধ কান্ড ঘটিয়ে সরকারপক্ষ যে ফাঁদ তৈরি করে সেই ফাঁদেই পা দিয়ে বিরোধীপক্ষ নিজেদের ভূমিকাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। তাদের মতে, মানুষ তাদেরকে নির্বাচিত করে বিধানসভায় পাঠিয়েছেন মানুষের কথা বলার জন্য। অথচ সেই কাজটাতেই যদি ফাঁকি থেকে যায় তাহলে মানুষই তো সেই জনপ্রতিনিদের কাছে জবাব চাইবেন। ভোট কেন্দ্রিক সংসদীয় রাজনীতিতে সেটা সুখকর হয় না বলেও মনে করছেন বিজেপি বিধায়কদের একাংশই। এ ব্যাপারে বিরোধী দলনেতার সঙ্গে আলাদা হবে আলোচনায় বসতে চান তারা।
বিধানসভায় বিরোধী বিজেপি দলের মুখ্য সচেতন শিলিগুড়ির বিধায়ক সংকট ঘোষ জানান ” বিধানসভা বিরোধীদের জায়গা এটা ঠিকই। কিন্তু সেটা নির্ভর করে শাসক দল বিরোধীদের কতটা জায়গা দিচ্ছেন তার ওপর। বিধানসভায় অনুপস্থিত বিধায়ক সাসপেন্ড করেন স্পিকার, বিরোধীদের মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেয়া হয় তাদেরকে বলতে দেওয়া হয় না এমনকি বিধানসভার কার্যবিবরণী থেকেও বাদ দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে মানুষকে বিধানসভার ভেতরের পরিস্থিতি জানানোটা অবশ্যই কর্তব্য।” শংকর ঘোষ আরো জানান, ” যে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের প্রশ্নের উত্তর দেন না, মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের বাজেট গিলোটিনে যায়, বাজেট বিতর্কের তালিকা থেকে বিরোধী বিধায়কদের নাম বাদ যায় সেই বিধানসভায় বিরোধীদের গুরুত্ব কতটা সেটাই তো প্রশ্নের মুখে। আর এই প্রশ্নেরই জবাব খুঁজতে বিধানসভার বাইরে জনসমক্ষে আমরা মানুষের দরবারে বিচার চাই।” যদিও শাসক দলের পক্ষে রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ” বিজেপি আগে নিজের দিকে তাকাক। লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী দিনের পর দিন গরহাজির থাকেন বা হাজির থাকলেও সমস্ত ইস্যুতে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন সেটা দেখে বিজেপির বোঝা উচিত আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শেখাও।” এ প্রসঙ্গে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বক্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্লাটিনাম জুবিলীতে বিধানসভার অধিবেশন কক্ষে নিজের বক্তব্য রাখতে গিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, সংসদীয় রাজনীতি হোক বা পরিষদীয় রাজনীতি অধিবেশন কক্ষে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা বা আলোচনা বিতর্ক বয়কট করা দুর্নীতির সমান। মানুষের দায়িত্ব নিয়ে বিধানসভায় এসে মানুষের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। আর বিশ্বাসঘাতকতা হল দুর্নীতির সমান অপরাধ। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির কথায়
“ডিসরেপশন ইজ আ করাপশন।” আপাতত এই আপ্ত বাক্যেই এখন বিবেক দংশনে ভুগছে বিরোধী শিবিরের একাংশ।
