লোকসভায় দাঁড়িয়ে তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু উত্থাপন করেন—ভারতের বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সংবাদমাধ্যমের সত্যনিষ্ঠা। তিনি প্রশ্ন তোলেন, বিচারব্যবস্থা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করছে এবং গণমাধ্যম সত্যের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় এই দুই স্তম্ভের ভূমিকা ও কার্যকারিতা। বিচারব্যবস্থার সিদ্ধান্ত ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের উপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাস কতটা টিকে আছে, তা নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সংসদে তাঁর এই বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে, যেখানে বিচার ও গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠে আসছে।
তাঁর বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উঠে আসে বিচারব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ। সম্প্রতি দিল্লিতে এক বিচারপতির সরকারি বাসভবনের কাছ থেকে পুড়ে যাওয়া বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় তিনি এই প্রসঙ্গ তোলেন।
মহুয়া জানিয়েছেন, তিনিও ব্যক্তিগতভাবে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। আলোচনার প্রসঙ্গে তিনি প্রয়াত বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু ও তার পরবর্তী ঘটনাবলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর মতে, সুশান্তের মৃত্যুর পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা অনেকের জন্য মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছিল। মহুয়া বলেন, সমাজে এই ধরনের ঘটনাগুলো যেভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা ব্যক্তির উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
তাঁর মতে, এই ধরনের সংবাদমাধ্যম বাস্তব ঘটনাকে বিকৃত করে নিজেদের সুবিধামতো গল্প তৈরি করে এবং বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তিনি দাবি করেন, এটি নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পরিপন্থী এবং জনমতকে ভুল পথে পরিচালিত করার একটি কৌশল।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বিচারপতি যশবন্ত বর্মার বাসভবন থেকে পোড়া টাকা উদ্ধারের ঘটনাকে উল্লেখ করেন, যেখানে তথ্যের বিকৃতি ও মনগড়া কাহিনি তৈরির মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা হয়েছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এই ঘটনার পর তাঁকে বিচারকার্য থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে এবং তদন্ত শুরু হয়েছে। কিন্তু মিডিয়া এটিকে নিয়ে একপেশে চিত্র তুলছে বলে তিনি মনে করেন।
মহুয়ার দৃষ্টিতে, এই মিডিয়া এখন বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে তর্ক উসকে দিচ্ছে, সরকারের প্রভাব বাড়ানোর পক্ষে সওয়াল করছে। তিনি বলেন, এটা কোনও একক ঘটনা নয়, বরং সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এক বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। তিনি আরও উল্লেখ করেন, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের নিয়োগে ইতিমধ্যে সরকারি দাপট দেখা গেছে।
তিনি মনে করেন, বিচারপতি যশবন্তের ঘটনা একটি উপলক্ষ মাত্র, যার আড়ালে কলেজিয়াম ব্যবস্থা ভেঙে ‘ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন’ (NJAC) পুনরায় চালুর চেষ্টা চলছে। বিষয়টি বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
রাজ্যসভার এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের মন্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, যার নাম প্রকাশ করা সম্ভব নয়, ইতিমধ্যে কলেজিয়াম পদ্ধতি বাতিলের পক্ষেই জোরালো অবস্থান নিয়েছেন।” তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, সরকারপক্ষের কিছু মহল দীর্ঘদিন ধরেই বিচারকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিজেদের হাতে আনতে চাইছে এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ ধরনের পরিবর্তন বিচার বিভাগের স্বায়ত্তশাসনের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে নানা মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কলেজিয়াম ব্যবস্থা রদ করে NJAC ফিরিয়ে আনার প্রয়াস সফল হলে, বিচারপতিদের নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে বিচার বিভাগ কী পদক্ষেপ নেয়, তা এখন বিশেষভাবে নজরে রাখা হচ্ছে।
Leave a comment
Leave a comment