অভিজিৎ বসু
রাতভর নাকি ভোররাত পর্যন্ত কেনাকাটা। শহর কলকাতার সেই চেনা রাস্তাগুলো আজ কেমন যেনো অচেনা হয়ে গেছে অনেকটাই। জাকারিয়া স্ট্রিট, পার্ক সার্কাস এবং নিউ মার্কেট, মির্জা গালিব স্ট্রীট এলাকায় আজ খুশীর জোয়ার আর ভীড়ে ঠাসা এই কলকাতা শহর। গোটা শহরের মানুষ যেনো আজ পথে নেমে পড়েছেন। আসলে এই ঘিঞ্জি, ব্যস্ত শহরেও আজ যে দেখা গেছে একফালি চাঁদ। বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাওয়া শহরে ওই ময়দানের ধূসর মাঠের কোণে চাঁদ উঠেছে ওই ফুল না ফুটলেও। ওই যে হাইরাইজ বিল্ডিং এর ফাঁকে দেখা যাচ্ছে মিষ্টি বাঁকা চাঁদের উঁকি। যে চাঁদ দেখেই ভীড় বেড়েছে শহরের এই সব নানা এলাকায়। দলে দলে মানুষ নেমে পড়েছেন রাস্তায় কেনাকাটি করতে। রেড রোডে পালিত হবে ঈদের নামাজ পড়া আর তারপর শুভেচ্ছা বিনিময় আর আলিঙ্গন এর পালা। এক মাস রোজার পর খুশির জোয়ারে ভেসে যাওয়া। সেই অনুষ্ঠানে হাজির থাকবেন সদ্য বিদেশ থেকে ঘুরে আসা আমাদের রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এইসব তো আছেই। উৎসবে অনুষ্ঠানে রাজনীতির নেতানেত্রীদের নিজেদের ব্যাপৃত রাখা। আর তার মাধ্যমে জনসংযোগ করার চেষ্টা করা। যা কাজে লাগে অনেক পরে ভোটের সময় হলে। এসব তো হিসেব নিকেশ করেই করা কিছুটা।
কিন্তু আজ রমজানের শেষ দিন জাকারিয়া পাড়ায় দেখা গেলো সেই তাশকিনের মেনুতে নানা কিসিমের শরবত আছে। যে শরবতের আবার নানা রকমের নাম। এর মধ্যে আছে দিল্লগি কী শরবত, আছে নফরত কী শরবত, আর আছে মহব্বত কী শরবত। সত্যিই অসাধারণ এই শরবতের সাম্রাজ্য। একদম ঠিক মুঘল সাম্রাজ্যের মতই যেনো। কিন্তু কেমন সেই স্বাদ কে জানে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অনেকবার চোখ পড়লেও এগিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়াবার সাহস হয়নি আমার। এই নফরত শরবত তৈরি হচ্ছে পেস্তা আর বাদাম এইসব দিয়ে। নফরত কে গিলে খাওয়ার কনসেপ্টটা বেশ ভালই কিন্তু। মন ভালো করার শরবত, মহব্বত এর শরবত বেশ ভালো ব্যাপার কিন্তু এই ব্যস্ত শহরের আনাচে কানাচেতে ছড়িয়ে আছে ঠিক এমন করেই। এই প্রোমোটারের দখলে চলে যাওয়া শহরে মহব্বত এর শরবত। ভাগ্যিস আকাশে আজ চাঁদ উঠেছিল। আজকাল তো দেখা যায় পাশাপাশি দুটো ধর্ম, আর দুটো উৎসবের সহাবস্থানের মাধুর্য নষ্ট করার একটা চেষ্টা দেখি সতত। কোনোও উৎসব এলেই কেমন একটা ভাগাভাগির চেষ্টা। তবু এখনও মনে হয় শেষতক নফরতের এনার্জি ফুরিয়ে যাবে। টিকে থাকবে এই শহরে শুধু ভালবাসা আর মহব্বতই। এত বিদ্বেষ ছড়ানোর এত চেষ্টাতেও এই অনুভবেই ইদ আরও মহিয়ান হয়ে ওঠে আমাদের কাছে।
আসলে সত্যিই তো এই চেনা শহরে আজ যে অন্য ছবি ভালোবাসার ছবি উপচে পড়ছে চারিদিক থেকে। কিন্তু এইসবের মাঝেও কেমন মন খারাপের ছবি ধরা পরে। খুশির ইদ বললেও লম্বা রমজান মাস শেষের পার্বণে হৃদয় ভারাক্রান্তও হয়। আজ শেষ বিকেলে জাকারিয়া স্ট্রীট এর এই উজ্জ্বল ছবিকেও কেমন যেনো বিষণ্ন লাগে। ঠিক যেমন অন্য অনেক উৎসব শেষের মধুর ক্লান্তিতে মনে হয়। আচ্ছা ওই যে রাস্তার ধারে বসে থাকা আগরার হালুয়া-পরোটা নিয়ে আসা চাচা চোখে সুরমা পড়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন সেই শাদুল্লার সঙ্গে দেখা হবে তো পরের বছর? আর সেই দিলশাদ ভাইয়ের ভাগ্নে আরবাজ তার আশ্চর্য নিহারি নিয়ে কি সেই ১১মাস বাদেই লখনউ থেকে আসবে? আলাউদ্দিনের আশ্চর্য সব ইফতারির জন্যও মন খারাপ হয় কেমন। আর তাই এই সুন্দর ভীড় উপচে পড়া সন্ধ্যায় মনে হয় জাকারিয়া পাড়া মানে তো শুধু একটা হুজুগ নয়, কলকাতার এই সব নানা এমন এলাকার মানুষ এর সাথে একটা আত্মীয়তাও! মাসভর রমজানে এ সব সম্পর্কের সুতোয়ও গিঁট পড়ে যায় কেমন ধীরে ধীরে আলতো করে।
সেই সব নানা মানুষ জন যাঁরা রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ বোঝে না। সেই সব মানুষজন যাঁরা ধর্মের সুতোয় কেমন করে হাত পা নেড়ে ভোটের সময় মারামারি করতে হয় একে অপরের বিরুদ্ধে সেটা বোঝে না। এইসব মানুষজন যাঁরা ওরা আর আমরা বোঝে না। এই সব মানুষজন রাজনীতির পাঠশালায় গিয়ে একে অপরের দিকে বন্দুক আর অস্ত্র তাক করার কথা ভাবে না। শুধু এরা এটা বোঝে যে মানুষ এর হৃদয়ে বেঁচে থাকে আল্লাহর দেওয়া ভালোবাসা আর সেই ভালোবাসাকে বুকে জড়িয়ে আগলে রহিম চাচা বেঁচে থাকেন আমাদের পাশের চক্রবর্তী বাড়িতে নির্ভয়ে নিরাপদে। আবার সেই মুর্শিদাবাদ জেলার অজ গ্রামে মুখার্জী বাড়ির দূর্গা পুজোয় সপরিবারে পাত পেড়ে অষ্টমীর ভোগ খেতে আসে হাসান এর পরিবার। কই তাদের তো কোনোদিন মনে হয়নি আমরা আর ওরা। কই তাদের তো মনে হয়নি তারা এই জাত আর আমরা ওই জাত। তাহলে রাজনীতির লোকদের এত চিন্তা কিসের এই আমাদের মত সাধারণ মানুষদের নিয়ে। সত্যিই অসাধারণ এই জাতের নামে বজ্জাতি আর স্বার্থসিদ্ধির খেলায় মেতে ওঠা। যে খেলা চলছে নিরন্তর। তাই শাদুল্লা , আরবাজ, হাসানদের আজ বড়ো চিন্তা হয়। সত্যিই কি তাহলে তারা সবাই ওই রাজনীতির লোকদের ক্রীড়নক হয়ে গেছেন ধীরে ধীরে নিজেদের অজান্তে। ওই দূর আকাশের বাঁকা চাঁদ দুর থেকে কেমন মিটিমিটি হাসে। আজ যে সত্যিই খুশির ঈদ।