ধ্বংসস্তূপ মায়ানমার, কাঁপছে উত্তর-পূর্বের পাহাড়, কতটা নিরাপদে ‘পাহাড়ের রানি’ সাধের দার্জিলিং?
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
(প্রথম পর্ব)
সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত মায়ানমার। মায়ানমারে বিস্তীর্ণ অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। এখনো পর্যন্ত ২০০০ এর বেশি প্রাণহানির তথ্য মিলেছে, জখম বহু। শুধু মায়ানমারই নয়, বিপর্যস্ত থাইল্যান্ডের ব্যাংককও। ভূকম্পনে শিহরণ জেগেছে মণিপুরেও। উত্তর-পূর্বের এই হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে ভূকম্পন প্রবণতা কম হলেও ইতিমধ্যেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আতঙ্কে রয়েছে সিসমিক ফোর এবং ফাইভ জোনে থাকা সিকিম ও দার্জিলিং পার্বত্য এলাকাও। ‘পাহাড়ের রানি’ দার্জিলিংয়ের বিপদ নিয়ে ইতিমধ্যেই চর্চা শুরু হয়েছে প্রশাসনিক মহলে। ২০১১ সালের, ১৮ সেপ্টেম্বর সিকিমে ভারত-নেপাল সীমান্তে কেন্দ্রীভূত হওয়া ভূকম্পের মৃদু ধাক্কাতেই কুপোকাৎ হয়েছিল দার্জিলিংয়ের পাংখাবাড়ি-বিজনবাড়ি এলাকার কিছুটা অংশ। ফের শিয়রে ভূকম্পনের আতঙ্ক। কতটা নিরাপদে ‘পাহাড়ের রানি’? এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে প্রশাসনের অন্দরেও। উন্নয়নের আলোয় কোথাও কি লুকিয়ে আছে বিপর্যয়ের আঁধার?
দু’তিন বছর আগে বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নোটিস জারি করেছিল দার্জিলিং পুরসভা।কাজের কজ কতটা হযেছে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও দেরীতে হলেও উপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে এই বিপদসঙ্কেত দীর্ঘদিনের।
আমরা বিপর্যয়ের কারণ, আগামীর ফলশ্রুতি এবং দার্জিলিংয়ের ভূ-প্রকৃতির বিশদ আলোচনা করব একাধিক পর্বে। আজ প্রথম পর্বে মূলত, দার্জিলিং পার্বত্য এলাকায় উন্নয়ন পরিকল্পনায় সরকারি নীতি এবং বিপর্যয়ের মূল কারণগুলি আলোচনা করা যাক।
উন্নয়নের সাধ তো থাকবেই, কিন্তু সাধপূরণে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকাটাও জরুরি। আর সেই লক্ষ্যমাত্রা স্থির করতে হবে বাস্তবের প্রেক্ষিতে। যেমন ধরা যাক বেআইনি নির্মাণের কথা। একদিকে ধসপ্রবণ এবং অন্যদিকে ভূকম্পপ্রবণ। এই চারিত্রিক বৈশিষ্টে দার্জিলিং ও সিকিম সমগোত্রীয়, সিসমিক জোন ফোর ও ফাইভের অন্তর্গত। স্বাভাবিকভাবেই এধরনের বিপদসঙ্কুল এলাকার জন্য ভূমির গঠন অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিল্ডিং রুল রয়েছে। তদনুয়ায়ী দার্জিলিংয়ে বাড়ির সর্বাধিক উচ্চতা হতে পারে১১.৫ মিটার।অর্থাৎ, সর্বাধিক সাড়ে তিন তলা বাড়ি তৈরি করা যেতে পারে। তাও আবার উপরের তলটি কাঠের নির্মাণ হতে হবে। ২০০০ সালের প্রথমদিকে রাজ্যের তৎকালীন বাম সরকারের সৌজন্যে দার্জিলিং পুরসভা বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ ঠেকাতে এই নিয়মকে শিথিল করে। সর্বাধিক উচ্চতার মাপ হয় ১৪.৫ মিটার। অর্থাৎ, পাঁচ তলা বাড়ির সমান। অথচ দার্জিলিং শহরে ৭-৮ তলা বাড়ি হামেশাই চোখে পড়ে। কখনও রাজ্য অথবা স্থানীয় প্রশাসন স্তরে কোনও পদক্ষেপের কথা ভাবাই হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই এই বাড়তি চাপ বহন করার মত ক্ষমতা দার্জিলিংয়ের আদৌ রয়েছে কিনা তা ভেবে দেখাটাও জরুরি। পক্ষান্তরে একই সিসমিক জোনে থাকা সিকিমের বিভিন্ন অংশে বিল্ডিং রুল (সরকারিভাবে) রয়েছে সর্বাধিক দেড় থেকে দু’তলা বাড়ির সমান উচ্চতা। এধরনের বৈষম্য দূর করে দার্জিলিংকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখতে অবিলম্বে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
দার্জিলিং পার্বত্য এলাকায় বিপর্যয়ের মূল দশটি কারণ–
১) নবীন পাললিক শিলায় গঠিত ভূমিরূপ যার ভূতাত্ত্বিক গঠন তুলনামূলক কমজোরি এবং টেকটোনিক শক্তি সক্রিয়। ফলে ধস ও ভূমিকম্পের প্রভাব বেশি।
২)পাতলা মাটির আস্তরণ যা ভূমিক্ষয়ের অন্যতম কারণ। অথচ মাটি মানচিত্র বা এই সংক্রান্ত কোনও ডেটাবেস নেই।
৩)ব্যাপকভাবে কংক্রিটের রাস্তা তৈরি এবং রাস্তা সংলগ্ন এলাকায় নির্দিষ্ট প্ল্যান ছাড়াই বড় বড় বাড়ি বা ইমারত তৈরি পাহাড়ে বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।
এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ মাটির স্তর বা প্লেট।
৪)গত দু’দশকে পাহাড়ে যেভাবে জনবিস্ফোরণ হয়েছে তার জেরে রাস্তাঘাটে ভারী ট্রাকসহ যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। প্রতিনিয়ত এই সমান্তরাল চাপের ফলে মাটির স্তর আরও আলগা হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভূ-স্তরও।
৫)জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রতিনিয়ত গৃহস্থ ও ব্যবসায়িকভাবে জলের চাহিদা বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই কমছে ভূ-গর্ভস্থ জলের স্তরও। ফলে জলের অভাব যেমন বাড়ছে তেমনি মাটির উপরের স্তর ক্রমে শুকনো ও ভঙ্গুর হচ্ছে।
৬)পাহাড়ি এলাকায় নদী উপত্যকা ছাড়া অন্য কোথাও মাটি বা পলি সঞ্চয় হয় না। বরং স্রোতের তোড়ে মাটির বাঁধন আলগা হয়ে যায়। অথচ মাটি সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থাই নেই।
৭) চা বাগানগুলোতে যাতে চা গাছের উপর ছায়া না পড়ে তাই কোনও বড় গাছ রাখা হয় না। ফলে ভূমিক্ষয় বাড়তে থাকে নিয়ম মেনেই।
৮) মাটির স্তর পাতলা হওয়া সত্ত্বেও ব্যাপক হারে নগরায়ন, বনাঞ্চল ধ্বংস এবং মাটির নীচে জন্মায় ( আলু, পিঁয়াজ, আদা, এলাচ) এধরনের ফসলের চাষ প্রতিনিয়ত ভূমিক্ষয় বাড়াচ্ছে।
৯)গ্রামীণ এলাকায় বা দুর্গম পাহাড়ে জ্বালানীর সন্ধানে নিম্নমানের কয়লা উত্তোলন বা দেদারে গাছ কেটে নেওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।
১০) ভূমি ব্যবহারের কোনও নির্দিষ্ট বিধি বা মানচিত্র না থাকায় জনসংখ্যার চাপ সামলাতে যথেচ্ছভাবে নগরায়ন বিপর্যয়ের শঙ্কা দিন দিন বাড়াচ্ছে।
ঘটনাচক্রে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জমি নষ্ট হয়ে গেলেও দীর্ঘদিন ধরে কোনও ক্ষতিপূরণ পান না পাহাড়ি গরিব মানুষরা। সর্বস্বান্ত হয়ে প্রতিনিয়ত ঋণের চক্রে আবর্তিত হতে হয় ওঁদের। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জমি নষ্ট হলেও মেলে না ক্ষতিপূরণ। তাই সব খুইয়ে তাঁদের আসতে হয় শহর এলাকায়। জোটে তুলনামূলক কম পারিশ্রমিক বা মজুরি। স্বাস্থ্যহানির কবলেও পড়তে হয়। সবমিলিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয় গরিবকে আরও গরিব করে তোলে পাহাড়ে।
——— ( চলবে)

