হিমালয় পার্বত্য এলাকায় কম্পন,তত্ত্ব বা তথ্যভিত্তিক নয় দার্জিলিঙের উন্নয়নে চাই অবস্থানিক বাস্তবতা
(দ্বিতীয় পর্ব)
দার্জিলিং পার্বত্য এলাকা হল নবীন ভঙ্গিল পর্বতের অংশ। হিন্দুকুশ হিমালয়ের নয়া সংযোজন। তাই ধীরে ধীরে উর্ধ্বমুখী হওয়া ‘টেকটোনিক ফোর্স’ এখনও সক্রিয়। ফলে এই পার্বত্য অঞ্চল ধস ও ভূমিকম্পপ্রবণ এবং সমতলের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের ভূমিরূপে গঠিত।
দার্জিলিঙের ভূমিরূপের বিভিন্ন গঠন———–
১) রেইজড সিরিজ– ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০ মিটার উঁচু। মূলত কাদামাটি ও বালির আস্তরণ। নুড়িপাথর বা কাঁকর, শিলা এবং বোল্ডারের মিশ্রণে এই স্তর গঠিত। তিস্তার পাড় ঘেঁষে কালিঝোড়ায় এই স্তরের আধিক্য রয়েছে।
২) শিবালিক — শ্লেট জাতীয় নরম শিলা এবং লিগনাইট মানের কয়লার গুঁড়োর সঙ্গে বালিপাথর, কাদাপাথরের মিশ্রণে গঠিত ভূস্তর। তিস্তা অববাহিকা অঞ্চল এবং হিলকার্ট রোড সন্নিহিত এলাকায় এই জাতীয় ভূস্তরের আধিক্য দেখতে পাওয়া যায়।
৩) ডামুদা সিরিজ– দক্ষিণ ভারতের গন্ডোয়ানা মালভূমির গঠন অনুযায়ী সামঞ্জস্যপূর্ণ কঠিন বালিপাথর, বিশুদ্ধ সাদা বালি, কার্বনযুক্ত শ্লেট জাতীয় শিলা দিয়ে এই ভূস্তর গঠিত। ১০০০ মিটার পর্যন্ত পুরু এই স্তরে ৩ মিটার পর্যন্ত কয়লার স্তর পাওয়া যায়। যার দেখা মেলে তিনধারিয়া এলাকায় এবং লিস ও গিস নদী অববাহিকায়।
৪) ডালিং সিরিজ– ক্লোরাইড জাতীয় কাদাপাথর, বিশুদ্ধ সাদা বালি মেশানো অভ্রযুক্ত শ্লেটপাথর এই ভূস্তরের উপাদান। যা ডামুদা সিরিজের উপর আস্তরণের মতো রয়েছে। এই স্তরের ভূমিরূপের আকার বিভিন্ন রকমের হয়। হিল কার্ট রোড ধরে তিনধারিয়া, পাগলাঝোড়ায় এই ধরনের স্তরের আধিক্য দেখা যায়।
৫) দার্জিলিং জিনেসিস– দার্জিলিং শহর ও সংলগ্ন পার্বত্য এলাকা এই ভূস্তরের অন্তর্ভূক্ত। এখানে শিলার প্রকৃতি বিভিন্ন আকারের।
বাধাধরা ছন্দে শুধু তত্ত্ব বা তথ্যভিত্তিক হয়েই মানুষের উন্নয়ন হয় না। অর্থনীতির ভাষায় মানুষের উন্নয়নকে বিচার করা উচিত অবস্থানিক বাস্তবতা বা পজিশনাল অবজেকটিভিটি দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই ভূপ্রকৃতির গঠন অনুসারে দার্জিলিঙে উন্নয়নের অভিমুখ অবশ্যই আলাদা হবে। সমতলের মত পরিকল্পনা তৈরি করে পাহাড়ের উন্নয়ন ইতিবাচক হওয়ার কথা নয়। দার্জিলিং পার্বত্য এলাকাকে সুইজারল্যান্ডের সমতুল তৈরি করার ক্ষেত্রেও যুক্তিটা একই। ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের পূর্বাংশে ইন্দো-নেপাল সীমান্ত বরাবর ভূস্তরের গঠন অনুযায়ী
অতি ভূকম্প প্রবণতা রয়েছে। যার ধাক্কা প্রতিনিয়তই সহ্য করতে হয় সিকিম ও দার্জিলিংকে। দার্জিলিংয়ের মাটির নীচে এই অশান্ত পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে NDMA (National Disaster Management Authority) ২০১২ সাল থেকেই দার্জিলিং ও সিকিমে ন্যাশনাল স্কুল সেফটি প্রোগ্রাম শুরু করেছে। যদি নিজেদের স্কুলবাড়িতে ফাটল ধরে তাহলে ফাটলের চারদিক থেকে জ্যাকেটিং করে কীভাবে তাকে ফের শক্তিশালী করা যায় তার হতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ছাত্রছাত্রীদের। প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর অথবা ২০১৩ সালের অক্টোবর, দার্জিলিঙের পাহাড়ে ধ্বংসলীলার জেরে প্রাণহানির পাশাপাশি বহু সম্পত্তি ও প্রাণিসম্পদ নষ্ট হয়েছিল তার মূলে ছিল নবীন ভঙ্গিল পর্বতের নড়াচড়া। তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে কালিম্পং ১, কালিম্পং ২ ব্লক এবং রাংলী-রাংলিয়ট ব্লক তিনটি সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। একইসঙ্গে কার্শিয়ঙের বিজনবাড়ি ও গরুবাথানের একাংশ এই বিপদসীমার অন্তর্ভূক্ত। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে এই এলাকায় জনবসতির ঘনত্ব এতটাই বেশি যে জীবন-জীবিকার সুরক্ষায় এলাকায় বনাঞ্চলের থেকে কৃষি এলাকার পরিমাণও বেড়েছে। যা মূলত মাটির নীচের ফসল উৎপন্ন করে। তাও আবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে, অর্থা্ৎ বর্ষার মরসুমের ঠিক পরেই। যখন মাটির ক্ষয় আরও বাড়ে। এর মধ্যে কালিম্পঙের অবস্থা সবচেয়ে বেশি জটিল বলে জানা গেছে। যেহেতু কালিম্পঙের ভূমিরূপ ততটা চড়াই-উতরাই নয় এবং চা বাগান নেই সেকারণে দার্জিলিং জেলার মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশই কালিম্পঙে বাস করে। তাছাড়া সাধারণ স্কুল-কলেজও এখানে বেশি। তাই জনবসতির চাপও দিন দিন বাড়ছে কালিম্পঙে। রাংলি-রাংলিয়ট, বিজনবাড়ি ও গরুবাথানের ভূস্তরের ভারসাম্যহীনতা এই ভয়াবহতাকে বাড়িয়েছে। একইভাবে তিনধারিয়া এলাকায় গিস এবং লিস নদীর বেসিনে অবৈধভাবে পাথর খনন এবং গিদ্দা পাহাড় এলাকায় অবৈধভাবে কয়লা উত্তোলনের জেরে ধস প্রবণতা অনেকগুণ বাড়িয়েছে। তিনধারিয়ায় ২০১১ সালের বিপর্যয়ে শিলিগুড়ি-দার্জিলিং হেরিটেজ টয় ট্রেনের যাত্রাপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা আজও পাহাড়বাসীর কাছে দগদগে। এখানেই শেষ নয়, ২৭ মাইল এলাকায় (সুরুক-সামথা এবং সামালবং গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে) তিস্তার উপর নিচু বাঁধ দেওয়ার ফলে ধস প্রবণতা স্থায়ী সমস্যা তৈরি করেছে। এজন্য জাতীয় সড়ক ৩১-এ ফিবছর নিয়ম করে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে বর্ষার মরসুমে। তাছাড়া গোটা পার্বত্য এলাকার মাটি খুবই পিচ্ছিল এবং নরম শিলাযুক্ত হওয়ায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বা অতিরিক্ত ভার বহনে অপারগ। স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত ভার তৈরি হলেই তা মাটিতেই মিশিয়ে দেয় এই নবীন শিলাস্তর। সমীক্ষা বলছে, গত ৫০ বছরে দার্জিলিঙে রাস্তাঘাটের পরিবর্তন হয়নি। অথচ জনবিস্ফোরণের জেরে গাড়ি বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। বিশেষ করে ভারী মালবাহী ট্রাক বা লরির চলাচলও বাড়ছে দিন দিন। যদিও পাতলা মাটির স্তরের উপর তৈরি হওয়া কংক্রিটের রাস্তা এই অতিরিক্ত ভারবহনে কতটা উপযুক্ত তার যথাযথ তথ্য নেই স্থানীয় প্রশাসনের কাছে।
(চলবে)