দার্জিলিং রক্ষায় ‘হিউম্যান এরর’ রুখে বাঁচাতে হবে বনাঞ্চল, চাই বৈচিত্রময় ভূমিরূপ অনুযায়ী নয়া শহর পরিকল্পনার সরকারি উদ্যোগ
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
(তৃতীয় তথা শেষ পর্ব)
বর্ধিত জনসংখ্যাকে ঠাঁই দিতে দার্জিলিং পার্বত্য এলাকায় পাল্লা দিয়ে কমছে বনাঞ্চল। মূলত, দার্জিলিং পার্বত্য এলাকায় পাঁচ রকমের বনাঞ্চল দেখতে পাওয়া যায়। ৩০০-১০০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত ক্রান্তীয় স্যাঁতস্যাঁতে পর্ণমোচি বনাঞ্চল। দক্ষিণ তিস্তা, গ্রেট রঙ্গিত ভ্যালি, গোক বনাঞ্চল এই পর্যায়ভুক্ত। পরবর্তী পর্যায় অর্থাৎ ক্রান্তীয় চিরহরিৎ নিম্ন বনাঞ্চল এলাকা ( ১০০০-২০০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত)। মূলত ধূপি বনাঞ্চল এই পর্যায়ের অন্তর্ভূক্ত। ২০০০-৩০০০ মিটার উচ্চতায় সাধারণত ঘন কুয়াশাযুক্ত এলাকায় দেখা মেলে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনাঞ্চলের। যেখানে রোডোডেনড্রন জাতীয় গাছ বেশি দেখতে পাওয়া যায়। পরবর্তী নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল ( ৩০০০-৩৫০০ মিটার উচ্চতা) এবং সংক্ষিপ্ত নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চলে (৩৫০০ মিটারের উপরে) মূলত উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলের গাছ দেখতে পাওয়া যায়। তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে দার্জিলিং জেলায় সিঞ্চল, ঘুম-সিমানা, তাগদা রেঞ্জ এলাকায় বনাঞ্চল প্রায় নেই বললেই চলে। এছাড়াও বিভিন্ন চা বাগান সংলগ্ন এলাকায় স্বাভাবিক বনাঞ্চল কমছে। বন কেটে সাফ হয়েছে ৫৫ নম্বর জাতীয় সড়ক সংলগ্ন এলাকাতেও। শহর এলাকার বনাঞ্চলও নিয়মিত কমছে। কার্শিয়ঙের সুকনা-পাঙ্খাবাড়ি অথবা কালিম্পঙের চেল-জলঢাকা ক্যাচমেন্ট এলাকাতেও বনাঞ্চল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে বলে অত্যুক্তি হয় না। বন দফতরের দায়িত্বে থাকা রাস্তাগুলোর হালও শোচনীয়। শুকিয়াপোখরি-মানেভঞ্জন, বাতাসিয়া কার্ট রোড, সিনকোনা-লালকুঠি কার্ট রোড, কার্শিয়ঙের শুকনা-সেবক রোড, রাসিয়াম-লাভা রোড, সাউথ বাউন্ডারি কার্ট রোড, সেন্ট্রাল কার্ট রোড এবং কালিম্পঙের দলগাঁও কার্ট রোড। এই রাস্তাগুলি কমজোরি হলেও সেখানে পণ্যাবহী লরির নিয়মত চলাচল বিপদ আরও বাড়িয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। আর এই সার্বিক ‘হিউম্যান এরর’-এর প্রভাব পড়ছে দার্জিলিং পার্বত্য এলাকায়। যার মাশুল গুনছেন শয়ে শয়ে গরিব পাহাড়িরা। এই মানুষগুলোর কথা ভেবে সরকারি উদ্যোগে যদি উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় তাহলেই শৈলশহরের সুসংহত সার্বিক উন্নয়নের সুফল রূপায়িত হবে।
স্বাভাবিকভাবেই বৈচিত্রময় ভূমিরূপের দার্জিলিং পার্বত্য এলাকার সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে যা যা বিবেচ্য তার মধ্যে অন্যতম হল দার্জিলিঙের ভূমিরূপ এবং তদনুযায়ী প্রশাসনিক নীতি ও উন্নয়নে পরিকাঠামো তৈরি করা। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, সাম্প্রতিক বছরে টেকটোনিক ফোর্সের তুলনায় ‘অ্যানথ্রপোসেনট্রিক ফোর্স’ বা ‘মানবকেন্দ্রিক শক্তি’ দার্জিলিঙে ধস-ভূকম্পের অন্যতম কারণ। ফলে সাধের দার্জিলিঙে সুসংহত জন উন্নয়ন রূপায়িত করতে হলে একদিকে সরকারিস্তরে স্থানীয় ভূস্তরের গঠন, তদনুযায়ী উপযুক্ত নির্মাণ পদ্ধতি এবং বিপর্যয়মুক্ত প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে, পরিবর্তন করতে হবে বাসিন্দাদের ব্যবহারিক ও অভ্যাসগত চালচলন, বন্ধ করতে হবে বেআইনি বহুতল ও রাস্তাঘাট নির্মাণ। স্বাভাবিক নিকাশির পরিবর্তন যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রথাগত চাষাবাদেও বদল আনা জরুরি বলেই মনে করছেন ভূ-তাত্ত্বিকরা। প্রশাসনিক উদ্যোগে তৈরি করতে হবে দার্জিলিং শহরাঞ্চলের বিশেষ টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি প্ল্যানিং। তৈরি করতে হবে মাটি মানচিত্র, মাটির সংরক্ষণও বাড়াতে হবে। পার্বত্য ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সুনির্দিষ্ট ডেটাবেস তৈরি করাও প্রয়োজন। নাহলে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনায় শুধু ব্যাঘাতই ঘটবে না, এক মুহুর্তের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধূলিস্মাৎ হতে পারে কাঙ্খিত উন্নয়ন। আর একথা মাথায় রেখেই দার্জিলিঙের প্রকৃত উন্নয়নে অবিলম্বে সরকারি স্তরে আরও বেশি উদ্যোগী হয়ে ‘বিশেষ সরকারি নীতি’ নেওয়া প্রয়োজন। অবশ্য ইতিমধ্যেই পাহাড়ে জলের জোগান বাড়াতে বালাসনসহ একাধিক প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। বৃষ্টির জল ধরে নয়া প্রকল্পও তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। বিপর্যয় মোকাবিলার বিষয়টি নিয়েও রাজ্য সরকারি স্তরে যে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে তারই প্রতিফলন সম্প্রতি দার্জিলিং পুরসভার বেআইনি নির্মাণ ভেঙে দেওয়ার ফরমান জারির ঘটনা। মূলত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দার্জিলিং শহরের জন্য নয়া টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি প্ল্যানিং তৈরি করার প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রাখতে হবে রাজ্য সরকার ও জিটিএ-কেও। —– ( শেষ)

 
			 
			 
                 
                                