ভূ-তলদেশের নিচে ঘটে চলেছে এক বিস্ময়কর প্রক্রিয়া, যা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে বিশ্বজুড়ে ভূবিজ্ঞানীদের মধ্যে। সম্প্রতি এক গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে, উত্তর আমেরিকার একটি বৃহৎ অংশের টেকটোনিক প্লেটের নিচের স্তর ধীরে ধীরে পৃথিবীর অভ্যন্তরের ম্যান্টলের দিকে চুঁইয়ে পড়ছে। এই ঘটনাটি এতটাই জটিল ও অজানা ছিল যে অনেকদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এর কোনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ‘টেকটোনিক ড্রিপিং’ নামের এই বিরল ভূ-প্রক্রিয়ার সন্ধান পেয়েছেন।
এই ‘ড্রিপিং’ প্রক্রিয়াটি মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডওয়েস্ট অঞ্চলে ঘটছে। সেখানে ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মাটির গভীরে থাকা প্লেটের অংশবিশেষ একধরনের নরম কাদামাটির মতো আকার নিয়ে ধীরে ধীরে ম্যান্টলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এটি কোনও ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরির মতো তীব্র ও তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া নয়, বরং লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ধাপে ধাপে গঠিত হওয়া এক প্রাকৃতিক রূপান্তরের প্রতিফলন।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এই প্লেটটি হল ফ্যারালন প্লেটের অবশিষ্টাংশ। এটি একটি বহু পুরনো সমুদ্রীয় প্লেট যা কয়েক কোটি বছর আগে উত্তর আমেরিকার অধীনে চলে যায় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সেই ভাঙা অংশগুলির কিছু এখনও ভূগর্ভে রয়ে গেছে এবং তারাই আজকের এই ‘ড্রিপিং’ ঘটনার মূল উৎস। গবেষকরা বলছেন, এই প্লেটটি কোনও স্থানে অতিরিক্ত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করছিল, যার ফলে তা নিচে ম্যান্টলের দিকে সরে যেতে শুরু করে। অনেকটা যেন ঠান্ডা গলানো চিজ যেমন ধীরে ধীরে পড়তে থাকে, তেমনি ভূগর্ভে থাকা সেই প্লেটটিও পড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর আরও গভীরে।
ভূতত্ত্ববিদেরা এই প্রক্রিয়াকে তুলনা করেছেন একটা দীর্ঘস্থায়ী ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে। এতে যদিও কোনও বড় ধরনের ভূমিকম্প বা মানব সভ্যতার ওপর তাত্ক্ষণিক প্রভাব পড়বে না, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূমিরূপ, খনিজ সম্পদের গঠন, এমনকি আগ্নেয়গিরি সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকী এই ‘ড্রিপিং’-এর কারণে কিছু এলাকায় অল্প হলেও জমি নিচু হতে পারে, আবার কিছু জায়গায় জমি সামান্য উঁচু হয়ে উঠতেও পারে।
এই সমীক্ষার অন্যতম গবেষক পিটার নিমানো বলেন, “এটি পৃথিবীর অভ্যন্তরে এক গভীর গতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়, যা আমাদের প্লেট টেকটোনিক্স সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিচ্ছে।” তাঁর মতে, আমরা এতদিন ভেবেছি ভূ-ভাগ কেবল উপরের দিকে সরছে বা কাঁপছে, কিন্তু এই গবেষণায় প্রমাণ মিলল, নিচে নামার ঘটনাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে প্রভাবশালী বিজ্ঞান জার্নাল ‘নেচার জিওসায়েন্স’-এ। এতে ব্যবহৃত হয়েছে ভূকম্পন তরঙ্গ বিশ্লেষণ, মাটির গভীরের তাপমাত্রা ও ঘনত্বের হিসেব এবং থ্রিডি মডেলিং প্রযুক্তি। গবেষকরা জানিয়েছেন, যদিও এই প্রক্রিয়া অনেক ধীর ও লক্ষ বছরের ব্যাপার, তবু পৃথিবীর ভূগঠনের ভবিষ্যৎ বোঝার জন্য এটি এক যুগান্তকারী আবিষ্কার।
তাদের মতে, পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে আমাদের যা দৃশ্যমান, তার চেয়ে অনেক বড় ও জটিল পরিবর্তন ঘটছে এই ‘অদৃশ্য ভূ-পরিকল্পনায়’। আর তারই এক ঝলক আমরা দেখছি এই ‘উত্তর আমেরিকার চুঁইয়ে পড়া’ ঘটনায়। এটি নিঃসন্দেহে আধুনিক ভূবিজ্ঞান চর্চার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা।