আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল রক্ত। কিন্তু সেই রক্ত যদি বেশি ঘন হয়ে যায় বা অস্বাভাবিকভাবে পাতলা হয়, তবে তা শরীরের জন্য ভয়ংকর বিপদের কারণ হতে পারে। রক্ত জমাট বাঁধার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যদি ব্যাহত হয়, তবে দেখা দিতে পারে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনির সমস্যা বা অতিরিক্ত রক্তপাতের ঝুঁকি। আর এই কারণেই চিকিৎসকরা প্রায়ই পরামর্শ দেন রক্তের ঘনত্ব নির্ণয়ের জন্য কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা করাতে।
রক্তের ঘনত্ব বোঝার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় দুটি পরীক্ষার মাধ্যমে—প্রোথ্রোমবিন টাইম (PT) ও অ্যাক্টিভেটেড পার্শিয়াল থ্রম্বোপ্লাস্টিন টাইম (APTT)। এই পরীক্ষাগুলি রক্তের জমাট বাঁধতে ঠিক কত সময় লাগে, তা নির্ধারণ করে এবং শরীরের ভেতরে রক্তপ্রবাহের স্বাভাবিকতা ঠিক আছে কিনা, সেই তথ্য দেয়।
প্রোথ্রোমবিন টাইম পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায় শরীরে রক্ত কত সময়ের মধ্যে জমাট বাঁধছে। যদি সেই সময়টা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়, তাহলে বুঝতে হবে রক্ত ঘন হয়ে যাচ্ছে, ফলে হঠাৎ ব্লকেজ বা হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়ে। আর যদি সময়টা বেশি হয়, তবে রক্ত অত্যন্ত পাতলা, যার ফলে কাটাছেঁড়া বা অল্প আঘাতেই অতিরিক্ত রক্তপাত হতে পারে।
অন্যদিকে, APTT পরীক্ষাটি রক্তের জমাট বাঁধার আরও গভীর স্তরের মূল্যায়ন করে। এই পরীক্ষায় রক্তে থাকা বিশেষ কিছু প্রোটিন কতটা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, তা বোঝা যায়। যাঁরা রক্ত পাতলাকারী ওষুধ গ্রহণ করেন, বা যাঁদের হেপারিন জাতীয় থেরাপি চলছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষার ফল চিকিৎসার দিক নির্দেশ করতে সাহায্য করে।
এই ধরনের পরীক্ষা কেবলমাত্র অসুস্থ মানুষদের জন্য নয়, বরং যারা নিয়মিত অ্যালকোহল পান করেন, উচ্চমাত্রায় তেল-মশলা খাচ্ছেন, অথবা পরিবারে হৃদরোগ বা ব্লাড ক্লটের ইতিহাস রয়েছে—তাদের জন্যও এই পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি। এমনকি যাদের শরীরে বারবার ক্ষত তৈরি হচ্ছে বা ঘা শুকোতে দেরি হচ্ছে, তারাও এই পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, শরীরের সামান্য সমস্যাকেও অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ, রক্তের সমস্যাগুলি বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বড়সড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় দেখা যায়, হঠাৎ কারও ব্রেন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে অথচ আগে থেকে কোনো উপসর্গ ছিল না। পরে জানা যায়, রক্ত অস্বাভাবিক রকম ঘন ছিল।
তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ, বছরে অন্তত একবার রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত, বিশেষ করে বয়স চল্লিশের গণ্ডি পার করলে। যাঁরা ওজন বেশি, উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন বা সুগারের রোগী, তাঁদের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষার গুরুত্ব আরও বেশি।
এই ধরনের পরীক্ষার খরচও খুব বেশি নয় এবং আজকাল বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই এই পরিষেবা পাওয়া যায়। অল্প একটু রক্ত সংগ্রহ করেই ফলাফল পাওয়া সম্ভব। কিছু ক্ষেত্রে, চিকিৎসক INR নামক আরেকটি পরীক্ষার পরামর্শও দেন, যা প্রোথ্রোমবিন টাইমের তুলনায় আরও বিস্তারিত তথ্য দেয়।
রক্তের সঠিক ঘনত্ব বজায় রাখা সুস্থ জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের ভেতরের এই নিঃশব্দ বিপদ সম্পর্কে সতর্ক থাকলেই ভবিষ্যতের বড় কোনও বিপদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব। তাই দেরি না করে, সময় থাকতে নিজের রক্তের অবস্থা যাচাই করুন—কারণ সচেতনতাই প্রথম চিকিৎসা।