চুইং গাম চিবোনো অনেকের দৈনন্দিন অভ্যাস। কারও অভ্যাসবশত, কারও মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে, আবার কেউ মনোসংযোগ বাড়াতে চুইং গাম চিবিয়ে থাকেন দিনের বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে এসেছে চমকে দেওয়ার মতো তথ্য—প্রতিদিন চুইং গাম খেলে তা শরীর, বিশেষ করে মস্তিষ্কের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। এই তথ্য সামনে আসতেই বিশ্বজুড়ে চিকিৎসক ও গবেষকরা মানুষকে সতর্ক থাকতে বলছেন।
সুইডেনের স্টকহোম ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা একটি বিশদ গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাজারে সহজলভ্য বেশিরভাগ চুইং গামে প্লাস্টিকজাত উপাদান থাকে, যেগুলিকে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ বলা হয়। এগুলি মূলত চুইং গামকে দীর্ঘস্থায়ী, নমনীয় ও আকার ধরে রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু এই মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরের ভিতর যে কীভাবে প্রবেশ করে এবং কীভাবে তা স্নায়ুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তা এতদিন স্পষ্টভাবে জানা ছিল না।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবার চুইং গাম চিবানোর সময় প্রায় ১০ লক্ষ মাইক্রোপ্লাস্টিক কণিকা মুখের ভিতর প্রবেশ করে। এই কণিকাগুলি শুধু দাঁতের ক্ষতি করে না, চিবোনোর মাধ্যমে মুখ থেকে পাকস্থলীতে চলে যায়, সেখান থেকে ধীরে ধীরে রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকী এই ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণিকাগুলি মস্তিষ্কের ব্লাড ব্রেন ব্যারিয়ারও অতিক্রম করতে সক্ষম, যার ফলে স্নায়ুকোষ বা নিউরনে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
গবেষকরা ইঁদুরের ওপর এই প্রভাব পরীক্ষা করে দেখেছেন। নিয়মিত মাইক্রোপ্লাস্টিক সংস্পর্শে আসার ফলে ইঁদুরদের স্মৃতিশক্তি ও শেখার ক্ষমতা কমে গেছে। তাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং বেশ কয়েকটি স্নায়ুর ধ্বংস লক্ষ্য করা গেছে। এই তথ্যগুলি থেকেই অনুমান করা হচ্ছে যে, নিয়মিতভাবে চুইং গাম খাওয়ার ফলে মানুষের ক্ষেত্রেও একই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের সমস্যা শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য আরও গুরুতর হতে পারে। তাদের মস্তিষ্ক তখনও বেড়ে উঠছে, এবং সংবেদনশীলতা অনেক বেশি। তাই অভিভাবকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা সন্তানদের এই অভ্যাস থেকে বিরত রাখেন এবং স্কুলের মধ্যেও এ নিয়ে সচেতনতা তৈরি হয়।
চুইং গাম ছাড়াও আমরা প্রতিনিয়ত আরও অনেকভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করে চলেছি—বোতলজাত জল, প্লাস্টিক মোড়কে প্যাক করা খাবার, এমনকী প্রসাধন সামগ্রীর মাধ্যমেও। কিন্তু চুইং গামের সমস্যা একটু আলাদা কারণ এটি সরাসরি মুখের ভিতর চিবানো হয়, ফলে দীর্ঘ সময় ধরে মুখ, দাঁত, জিভ, লালা ও খাদ্যনালির মাধ্যমে শরীরের ভিতরে প্রবেশের সুযোগ বেশি।
গবেষণা প্রকাশ্যে আসার পর বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই প্লাস্টিক মুক্ত চুইং গাম বাজারে আনার পথে এগোচ্ছে। অনেক সংস্থা প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি চুইং গাম তৈরির দিকে ঝুঁকছে যাতে গাম খাওয়ার আনন্দে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা না থাকে।
তবে তার থেকেও বেশি জরুরি হচ্ছে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা। সব বিজ্ঞাপন বা মোড়কে লেখা উপাদান সম্পর্কে জানতে হবে, বুঝে খাবার বেছে নিতে হবে। এবং অবশ্যই যেকোনো পণ্য, তা যত ছোটই হোক না কেন, প্রতিদিন গ্রহণ করা হলে তার প্রভাব শরীরে পড়বেই—এই বার্তাটি সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।
চুইং গাম খাওয়া ক্ষতিকর—এই বক্তব্যকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে ধরা না গেলেও, গবেষণা বলছে নিয়মিত ও মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। ভবিষ্যতে মাইক্রোপ্লাস্টিক সংক্রান্ত আরও গবেষণা আমাদের সামনে এই অভ্যাসের নানান দিক তুলে ধরবে, কিন্তু এখন থেকেই সতর্ক না হলে পরবর্তীতে বড় সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।