অভিজিৎ বসু
এ বসন্তের বিলাপ নয়। একদম খর রৌদ্রের প্রখর বৈশাখে ধেয়ে আসছে কালবৈশাখীর ঝড়। যে ঝড় উঠেছে আজ গোটা বাংলা জুড়ে। রাজনৈতিক ঝড় নয় একদম প্রেমের বালি ঝড়। যে ঝড়ে আজ বেসামাল বঙ্গ বিজেপির ডাকাবুকো নেতা দিলীপ ঘোষ। হ্যাঁ, একসময় যাঁর নেতৃত্বে এই রাজ্যে গেরুয়া ঝড় হয়েছিল। সেই বিজেপির হি ম্যান, মাসল ম্যান, সেই রামের জন্মদিনে লাঠি খেলা করা দিলীপ ঘোষ, সেই হাফপ্যান্ট পড়া আর এস এস এর ‘রাম’ সীতাকে বিয়ে করে কী মমতাময় ‘দিদি’ মমতাময়ীকে রাজ্য ছাড়া করা সম্ভব নয় বলেই তিনি এই বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লেন? কে জানে এই বিয়ে তো আর অনুষ্কার সাথে বীরুর বিয়ে নয়, এই বিয়ে পুরোনো সাদা কালো বাংলা সিনেমার সেই উত্তম সুচিত্রার জুটির এই পথ চলা মিষ্টি প্রেমের কাহিনী। যে কাহিনীতে যেখানে রাজনীতির মারপ্যাঁচ, দলের অন্দরের নানা ধরনের আকচাআকচি আর ঠেলাঠেলিতে অসম প্রতিযোগিতা নেই। একদম শুধুই নিখাদ ভালোবাসা আর মায়ের কথা রেখে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়া।
যে কাজটা একসময় তপন শিকদার পারেননি। সেই কাজটাই করে দেখালেন তাঁর উত্তরসূরি ডাকাবুকো বিজেপির এই ঠিক পোস্টার বয় নয় মাস্টার বয় দিলীপ ঘোষ। যে দিলীপ ঘোষ বহু বিতর্কিত মন্তব্য করে ইতিমধ্যে হৈ চৈ হুল্লোড় ফেলে দিয়েছেন বারবার। দিলীপ ঘোষ ছিলেন সংঘের প্রচারক। সংঘের নির্দেশেই তাঁর ২০১৫ সালে তাঁর প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে প্রবেশ। জীবনের অর্ধ শতক পার করে রাজনীতিতে অভিষেক তাঁর। বঙ্গ বিজেপির কান্ডারী হিসেবে তিনি ২০১৯ সালে সাফল্যের অনন্য নজির গড়েছিলেন একসময়। যে রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারে নি বঙ্গ বিজেপিতে। দলীয় রাজনীতিতে যোগদানের পর তাঁর প্রায় একদশক কেটে গেছে এরপর তিনি অন্য এক জগতে প্রবেশ করছেন। জীবনের এই শেষ ভাগে পৌঁছে এই টি টোয়েন্টি স্টাইলের ব্যাটিং করা দেখে মনে হয় এটাই তাঁর একমাত্র ইউএসপি সেটা রাজনীতিতে হোক বা জীবন নীতিতে হোক বা ভালোবাসার মানুষকে জীবনে স্বীকৃতি দেওয়াতে হোক। এমনটা বোধহয় একমাত্র তাঁকেই মানায়। আসলে এই যে তাঁর দ্রুত গতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সেটাই বোধহয় এই রাজ্যে তাঁকে অন্য বিজেপি নেতাদের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে রেখেছে আজও এই বাংলায়।
ঠিক এই কথা লিখতে বসে মনে পড়ে যায় সেই বাজপেয়ি মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রীকে। পার্টির শীর্ষ স্তর থেকে বার্তা দেওয়া হয় বান্ধবীকে ছাড়ুন নয়তো বিয়ে করুন। লালকৃষ্ণ আদবানির প্রিয়পাত্র তপন শিকদার তখন মন্ত্রী। তাঁর বয়স তখন মধ্য পঞ্চাশ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের অনুশাসন কঠোর। লিভ ইন বা বিবাহ বহির্ভূত একত্রবাসের অনুমোদন নেই। তপন বাবুর বান্ধবী বিবাহিতা। আনুষ্ঠানিক ডিভোর্স হয়নি। একমাত্র পুত্র সন্তানের জননী। সংসার করতেন তিনি সেই তপন শিকদারের সঙ্গে উত্তর কলকাতার সেই ভূপেন বোস এভিনিউতে তাঁদের একসাথে থাকা। যা নিয়ে অনেক কথা হলেও আমল দেননি দুজনের কেউ। তপন শিকদার এর সু সময়ে যেমন তিনি ছিলেন ঠিক তেমনি তাঁর পাশে আবার খারাপ সময়েও তিনি ছিলেন। মুরলিধর সেন লেনের বিজেপির দফতরে তাঁর সেই বান্ধবীর সেই সময় বেশ দাপট। যদিও বিজেপিতে আদবানির জমানা শেষ হবার পর থেকে সবাই তপন শিকদার এর পাশ থেকে সরে গেলেও সেই প্রেমের মানুষটি সরে যাননি মৃত্যু পর্যন্ত।
রাজনীতিতে আছেন বলে কি আর প্রেম আসবে না জীবনে এটা হয় নাকি? বিজেপির প্রথম সভাপতি হরিপদ ভারতী অবিবাহিত ছিলেন। তৃতীয় সভাপতি সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও অবিবাহিত। তপন শিকদার এবং দিলীপ ঘোষ দুজনেই প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি।
দিলীপ ঘোষের বিয়ের খবর তিনি নিজে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেছেন এমন নয়। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে এই খবর ফাঁস হয়। পাত্রী রিঙ্কু মজুমদার। তিনি বিবাহ বিচ্ছিন্না। তাঁর এক পুত্র তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কলকাতায় কর্মরত। গুড ফ্রাইডের দিন দিলীপ ঘোষের রাজারহাট নিউটাউনের বাসভবনে আক্ষরিক অর্থেই নামমাত্র আয়োজনে তাঁদের বিয়ে। কন্যাপক্ষের তরফে, তিনজন। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার সহ মোট দশ জন সেখানে আমন্ত্রিত। ক্যাটারার নয়, ঘরোয়া রান্না। নারায়ণকে সাক্ষী রেখে পুজো, মালা বদল ব্যাস ঐটুকুই। দলের সহকর্মীরাও আমন্ত্রণ দূর আনুষ্ঠানিক ভাবে জানতেও পারেননি বিয়ের খবর। বেশ একদম চুপ চাপ ফুলে ছাপ এর মতোই ব্যাপারটা।
রাজ্য জুড়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা। সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে বিতর্ক, হিংসা। নিয়োগ কেলেঙ্কারি নিয়ে শাসক তৃণমূলের সঙ্গে সংঘাত যখন তুঙ্গে। রাজ্য বিজেপির বর্তমান সভাপতির মেয়াদ শেষ হলেও নতুন মুখ খুঁজতে হিমশিম যে সময় পদ্ম বাহিনী। দ্রুত পরিস্থিতি বদলের নানা ইঙ্গিত মিলছে রাজধানী থেকেও। বাংলা নিয়ে রোড ম্যাপ এখনও অনিশ্চিত। সব মিলিয়ে এই পর্বে দিলীপের বিয়ে নিয়ে কিঞ্চিৎ বিড়ম্বনায় তাঁর দলের বঙ্গীয় সতীর্থরা। কিন্তু সেটা ভাবলে কী আর চলে তাই দিলীপ ঘোষ নিজের স্টাইলে মাছ ধরার মতই ছিপ ফেলে নিজের ঘরে মাছ তুলে আনলেন নিজের বুকের পাটায়। যে স্টাইলে তিনি সারা জীবন কাটিয়ে গেলেন তাঁর নিজের জীবন নিয়ে।
এই বিয়ে নিয়ে এখন বেশ শোরগোল পড়ে গেছে। কুণাল ঘোষ এর পোস্ট থেকে অনেকেই জেনে গেছেন সেই খবর। যা কিছুটা বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছে পদ্ম শিবিরের নেতাদের। ‘তাঁদের দাদার বিয়ের’ খবর শাসক শিবির থেকে শুনতে হচ্ছে তাদের। যেটা বেশ অস্বতির বিষয় তো বটেই। তবু একদম দিলখোলা আমাদের দীলিপ দা কেমন প্রেমের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেও বেশ সতর্ক। বাকপটু আর স্পষ্ট বক্তা বলে রাজনৈতিক মহলে সুবিদিত দীলিপ বাবু তাঁর ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে এই বিয়ের খবরে কেনো এত ঢাক ঢাক গুড় গুড় কে জানে। প্রেমে পড়লে বোধহয় এমনটাই হয়। রাজনীতিক নেতাদের তো প্রাইভেট লাইফ আর পাবলিক লাইফে ফারাক নেই বললেই চলে। তবুও প্রেমের মিষ্টি ঝড়ে কেমন বেসামাল বাংলার দামাল যুবক দিলীপ ঘোষও। বৈশাখের সন্ধ্যায় হবে চার চোখ আর চার হাতের মিলন। শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে হয়তো মুখর হবে না তাঁর নিউটাউনের সেই বিশাল ফ্ল্যাট। দেখা যাবে না এই অনুষ্ঠানে মোদী, অমিত শা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা মহম্মদ সেলিম কে, বা শুভেন্দু অধিকারী আর সুকান্ত মজুমদারকে।
তবু তপন শিকদার, দিলীপ ঘোষ, সুকুমার বন্দোপাধ্যায় এঁদের মধ্যে অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন আমাদের দিলীপ ঘোষ। বঙ্গ বিজেপির এই হাফ প্যান্ট পড়া নেতা। যিনি বলতে পারেন তৃণমূলকে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে তাঁর এক মিনিট সময় লাগবে না তিনি জানেন কোন ওষুধে কী কাজ হয়। যিনি জানেন কোন বলে ছয় আর কোন বলে শর্ট রান নিতে হয়। আর ঠিক তাই জীবনের মাঠে খেলতে নেমে একদম প্রথম ওভারেই ছয় হাঁকিয়ে তিনি জানিয়ে দিলেন সবাইকে তিনি তাঁর নিজের ভালোবাসার মানুষকে তিনি স্বীকৃতি দিচ্ছেন এতে এতো হৈচৈ এর কি আছে। হাফ প্যান্ট পড়া দিলীপ বাবু যে আজ ধুতি পাঞ্জাবী পরে গলায় মালা পড়ে বর বেশে লাজুক মুখে বসে পড়বেন বিয়ের পিঁড়িতে তাঁর ভালোবাসার মানুষের পাশে। নাই বা হলো তাঁর রাজ সিংহাসনে আরোহণ এই বিয়ের সিংহাসনে আরোহণটাও তো বেশ কঠিন কাজ। যেটা তিনি করে ফেললেন অনায়াসেই। ভালো থাকবেন আপনারা দুজন। মা আর ছেলের সংসারে এখন তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ। আজকের ভালোবাসার দিনে এসব রাজনীতি বাদ দিয়ে না হয় একটু অন্য ভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করুক দিলীপ ঘোষ আর তাঁর ভালোবাসার পাত্রী রিঙ্কু। যতই হোক দিলীপ ঘোষ যা পারলেন আর পেরেছেন এই বঙ্গের বিজেপির অনেকেই সেটা করতে পারেন নি। কী রাজনীতিতে আর কী জীবনের পথে। শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন আপনি। ভালো থাকুন দাদা। এই স্টাইলে ব্যাট করুন। যেটা একমাত্র আপনাকেই মানায়।