মরাঠি ভাষায় ‘অজিঙ্ক’ শব্দের অর্থ ‘অপরাজেয়’। কিন্তু আইপিএলের চলতি মরসুমে অজিঙ্ক রাহানের পারফরম্যান্স দেখে এই নামের সঙ্গে বাস্তবতার ব্যবধান স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) অধিনায়ক হিসেবে প্রথম আট ম্যাচের মধ্যে পাঁচটিতেই হার—এই পরিসংখ্যান রাহানের নেতৃত্ব নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে। চ্যাম্পিয়ন দলের দায়িত্ব পেয়ে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তার ধারে-কাছে যেতে পারছেন কি তিনি?
ইডেন গার্ডেন্সে ঘরের মাঠে প্রথম ম্যাচেই পিচ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন রাহানে। পঞ্জাবের বিরুদ্ধে ১১২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে না পেরে হারের দায় নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন তিনি। অধিনায়ক হিসেবে দায় নেওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আইপিএলের রুক্ষ বাস্তবতা হলো—জয়ই চূড়ান্ত নির্ধারক। এখানে হার মানেই জায়গা হারানোর সম্ভাবনা। কেকেআরের ইতিহাসও সেই কথাই বলে—দীনেশ কার্তিককেও মাঝমাঠে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
চলতি মরসুমের আগে কেকেআর শ্রেয়স আয়ারকে ছেড়ে দেয়। ২০২৩ সালের আইপিএলে তাঁর অধিনায়কত্বেই চ্যাম্পিয়ন হয় দল, তবুও তাঁকে দলে রাখা হয়নি। পরবর্তী অধিনায়ক নিয়ে জল্পনা শুরু হয় নিলামের আগেই। কেকেআর ২৩.৭৫ কোটি টাকা খরচ করে দলে ভেড়ায় বেঙ্কটেশ আয়ারকে। দলে ছিলেন আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইনের মতো অভিজ্ঞরা। অথচ অধিনায়ক করা হয় টেস্ট অভিজ্ঞ রাহানেকে, যিনি ভারতের হয়ে বিদেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতিয়েছেন বটে, তবে আইপিএলের মতো হাই-ভোল্টেজ টি-টোয়েন্টি মঞ্চে তাঁর দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
রাহানের দীর্ঘদিনের কোচ প্রবীণ আমরে মনে করেন, তাঁর ছাত্র সকলের মত শোনে, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২০-২১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় কোহলিহীন ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়ে বর্ডার-গাভাসকর ট্রফি জেতানো ছিল রাহানের অন্যতম সেরা কীর্তি। তবে সেটি ছিল পাঁচদিনের টেস্ট ক্রিকেট। আইপিএল সম্পূর্ণ আলাদা এক বাস্তবতা—যেখানে দ্রুত পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, একঘেয়ে পরিকল্পনায় চলে না।
রাহানের অধিনায়কত্বে সবচেয়ে বড় সমস্যা বলা হচ্ছে তার ‘একরৈখিক চিন্তাভাবনা’। ম্যাচের পরিস্থিতি, প্রতিপক্ষ বা মাঠের চরিত্র বদলালেও তিনি নিজের পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনাতেই অটল থাকেন। উদাহরণ হিসেবে, এক ম্যাচে আন্দ্রে রাসেল উইকেট নেওয়ার পরেও তাঁকে আর বল হাতে তুলে দেননি রাহানে। প্রশ্ন ওঠে, অধিনায়ক কি নিজের কৌশলের খুঁত দেখতে পাচ্ছেন?
রাহানের নেতৃত্বে এর আগে রাজস্থান রয়্যালস ও রাইজিং পুণে সুপারজায়ান্টস খেললেও সাফল্য তেমন আসেনি। আইপিএল শুরু হওয়ার আগে তাঁর নেতৃত্বে রেকর্ড ছিল ২৫ ম্যাচে মাত্র ৯টি জয়। চলতি মরসুমের শুরুতে সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে সর্বাধিক রান করে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন তিনি—৯ ম্যাচে ৪৬৯ রান, স্ট্রাইক রেট ১৬৪.৫৬। তবে সে টুর্নামেন্টে নেতৃত্ব দেননি তিনি, দায়িত্ব ছিল শ্রেয়স আয়ারের হাতে। সেটাই কি কেকেআরের নেতিবাচক ইঙ্গিত ছিল?
ভারতীয় প্রাক্তন ক্রিকেটার হরভজন সিংহও প্রশ্ন তুলেছিলেন—শুধু নেতৃত্বের জন্য রাহানেকে দলে নেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়? তাঁর মতে, বেঙ্কটেশ, নারাইন বা রাসেলও হতে পারতেন নেতা। আরেক প্রাক্তন, মহম্মদ কইফ তো রাহানেকে ‘স্বার্থপর’ হতে বলেছিলেন। এক ম্যাচে আউট না হয়েও রাহানে রিভিউ না নিয়ে মাঠ ছেড়ে দেন, যেন দলের একটি রিভিউ নষ্ট হবে না ভেবেই। কইফের মতে, এমন পরিস্থিতিতে রাহানেকে ভাবতে হতো তিনিই দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটার, এবং একটি রিভিউ দলের জন্যই জরুরি।
তবে রাহানের চরিত্র একেবারেই ভিন্ন। তিনি পরিশ্রমী, শৃঙ্খলাপরায়ণ, নিজের অবস্থান গড়ে তুলেছেন মুম্বইয়ের শহরতলি থেকে উঠে এসে। কোচ আমরে বলেন, “ও এমন ছাত্র, যাকে যে কোনও কোচ পেলে ভাগ্যবান মনে করবেন। কঠোর পরিশ্রম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, এবং দলের জন্য নিঃস্বার্থ—সব গুণই ওর মধ্যে আছে।” কিন্তু আইপিএলে এই গুণগুলো যথেষ্ট নয়।
আইপিএল এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে পারফর্ম না করলেই সরিয়ে দেওয়া হয়। চূড়ান্ত বাস্তববাদী ও চাপে-ভরা এই টুর্নামেন্টে নেতৃত্ব মানে শুধু মাঠের কৌশল নয়, মানসিক দৃঢ়তাও। এখনও ছ’টি ম্যাচ বাকি রয়েছে কেকেআরের। প্রত্যেকটি ম্যাচ কার্যত ‘করো অথবা মরো’র সমান। এই ছ’টি ম্যাচে যদি রাহানে তাঁর অপরাজেয় নামের সত্যতা প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে তাঁর অধিনায়কত্বও প্রশ্নের মুখে পড়বে। যেমনভাবে তাঁর অধিনায়কত্ব এসেছে আলোচনায়, তেমন ভাবেই চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।