মগজাস্ত্রের প্রাধান্য কমে যাওয়া, ভুল সরকারি নীতি ও রাজনৈতিক স্বার্থই বাধা দেশের সুরক্ষায়?
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
পাহালগাওঁয়ে জঙ্গিদের সুপরিকল্পিত আক্রমণ বিন্দুমাত্র আজ করতে পারেননি ভারতের নিরাপত্তাকর্তা থেকে গুপ্তচর সংস্থা! তাহলে কি ভারতের নিরাপত্তার রক্ষা থেকে গুপ্তচর ভিত্তিতে পারদর্শিতার অভাব রয়েছে? প্রধানমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় সরকার যাই বলুন না কেন এই প্রশ্নই এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে সমস্ত মহলে। বিশেষ করে যাদের মগজাস্ত্র বিশ্বজুড়ে বন্দিত ভারতের সেই অন্যতম গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইং সংক্ষেপে RAW এর ভূমিকায় কি গলদ রয়েছে? সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিচারে এই প্রশ্ন যথেষ্টই সঙ্গত। কারণ, পাহালগাঁওয়ের ঘটনা গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্নের ভান্ডার খুলে দিয়েছে। পাহালগাঁওয়ে পর্যটন মরসুমে পর্যটকদের ভিড় কতটা থাকে তা জানা সত্ত্বেও সেখানে ন্যূনতম নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না কেন? প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে হত্যালীলা চললেও নিরাপত্তারক্ষীদের টিকি দেখা যায়নি কেন? শুধু পাহালগাঁও কেন, আমেরিকা ও কানাডায় খলিস্থানপন্থীদের তান্ডব থেকে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে হাসিনা বিরোধী অভ্যুত্থান, হাসিনা সরকারের উৎখাত এমনকি প্রাণে মারার কৌশলের খবর সবকিছুই ভারতীয় গোয়েন্দাদের ব্যর্থতাকে প্রকট করেছে। এর আগে ২০০৮ সালের মুম্বই হামলা বা তারও অনেক পরে ২০১৯ এ পুলওয়ামা হামলা সব ক্ষেত্রেই ভারতীয় গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা প্রকাশ্যে এসেছে। প্রশ্ন উঠছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের এই ব্যর্থতার ‘গোড়ায় গলদ’ কোথায়?
প্রশাসনিক মহলের একাংশের ধারণা আন্তর্জাতিক স্তরে বা বিভিন্ন দেশে ভারতের নিরাপত্তা কূটনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে যে তিন প্রধান মূল দায়িত্বে থাকেন তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এই তিন প্রধান হলো জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, বিদেশ মন্ত্রক এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। বাংলাদেশের উত্তাল পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে ভারতের এই তিন প্রধানের সমন্বয়ের অভাব বারবার আলোচনার শীর্ষে উঠেছে। বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও বিদেশমন্ত্রীর মধ্যে ‘টাগ অফ ওয়ার’ সর্বজনবিদিত। এই পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে গোয়েন্দা তথা গুপ্তচর সংস্থার ক্ষেত্রেও। তার পাশাপাশি সীমান্ত সুরক্ষায় পরিকাঠামোর অভাব এবং সরকারি নীতির গাফিলতি সামনে এসেছে। এখনো ভারতীয় সীমান্তে স্যাটেলাইট নির্ভর থার্মাল ইমেজিং সিস্টেমের যথেষ্ট অভাব। যে কারণে পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের সীমান্ত এলাকা যথেষ্ট দুর্বল বলে পরিচিত। মনে রাখতে হবে এই পশ্চিম সীমান্ত থেকেই মুম্বাই হামলার জঙ্গিরা ভারতে প্রবেশ করেছিল। শুধু সীমান্ত পরিকাঠামো নয়, গুপ্তচর সংস্থা র-তে আধা সামরিক বাহিনী বা আইপিএসদের ডেপুটেশনে কাজ করানো হচ্ছে। অনেকটা এরা যে পুলিশের বদলে সিভিক ভলান্টিয়ার দিয়ে কাজ করানোর মতো। কারণ আধা সামরিক বাহিনী বা আইপিএস রা দৈহিকভাবে শক্তিশালী বা পুলিশি ব্যবস্থা অথবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে মিধা সম্পন্ন হলেও আন্তর্জাতিক গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে যে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ বা মেধা শক্তি প্রয়োজন সেই মগজাস্ট্র তাদের কতটা রয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরাই। অর্থাৎ RAW তে নিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরনের ডেপুটেশন পোস্টিং শুধুমাত্র এই গুপ্তচর সংস্থার পারদর্শিতাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে না দায়বদ্ধতাহীন এই ধরনের নিয়োগের ফলে দেশের সুরক্ষা প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। কারণ RAW তে বা গুপ্তচর বৃত্তিতে যে ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, আড়ালে থেকে নিজস্ব নেটওয়ার্কিং তৈরীর ক্ষমতা প্রয়োজন হয় এবং বেশ কিছু নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের প্রয়োজন তার সঙ্গে শারীরিক সম্পদ বা বল প্রয়োগের কোনো সম্পর্ক নেই। সে ক্ষেত্রে আধা সেনা বা পুলিশ সার্ভিসের আধিকারিকদের এই কাজে যুক্ত করে কাঙ্খিত ফললাভ সম্ভব নয় বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। আর এখানেই বারবার পিছিয়ে পড়ছে ভারতীয় গোয়েন্দা বা গুপ্তচররা। প্রতিবেশী দেশ গুলিতে প্রতিনিয়ত যে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে যার ফলে দেশের সুরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত আসতে পারে এ ধরনের খবরে প্রতিনিয়ত মার খাচ্ছেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। যার নবতম সংযোজন পাহালগাঁও।
এ তো গেল পরিকাঠামোর অভাব বা সরকারি নীতির অদূরদর্শিতার কথা। সমস্যার গভীরে রয়েছে রাজনীতিও। ২০০৮ এ মুম্বাই হামলার পর তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম ‘ ন্যাশনাল কাউন্টার টেরোরিজম সেন্টার’ তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যেখানে রাজ্যের গণ্ডি অতিক্রম করেই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে রাজ্যের পুলিশের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে দ্রুত যেকোনো রাজ্যে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা, যেকোনো রাজ্যে গিয়ে অভিযুক্তকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা এবং নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করার মতো সংস্কার মূলক প্রস্তাব আনা হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের সুরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করতে এই সংস্কার মূলক পদক্ষেপ করার চিন্তাভাবনা হয়েছিল দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে। দেশের নিরাপত্তা কাঠামোর আমল বদলি ছিল এই সংস্কারের মূল লক্ষ্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর আদর্শ, রাজ্যের স্বাধীনতায় কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ, কেন্দ্র-রাজ্য সহযোগিতার প্রশাসনিক আদর্শের বিপরীত ধর্মী বলে উল্লেখ করে একগুচ্ছ রাজনৈতিক স্বার্থে এই সংস্কারমূলক পদক্ষেপ আটকে দেওয়া হয়। সংকীর্ণ রাজনীতি স্বার্থে দেশের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই পদক্ষেপ যদি গৃহীত হতো তাহলে দেশের সুরক্ষা ব্যবস্থার অনেকটা সুরাহা আহত বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে দেশের সীমান্ত সুরক্ষা বা আন্তর্জাতিক স্তরে এই গোয়েন্দা ব্যর্থতার সমস্যা শিকড় অনেক গভীরে বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
