নাটকীয়তা যেন পিছু ছাড়ছে না বঙ্গ রাজনীতির। মমতার পাশে বসে একই ফ্রেমে ছবি—এই দৃশ্য দেখে চমকে উঠেছিল অনেকেই। বিশেষ করে যখন ছবির বাকি দুই মুখ দিলীপ ঘোষ ও রিঙ্কু। দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনের দিন এক মুহূর্তেই যেন তৈরি হয়ে গেল রাজনৈতিক বিস্ফোরণ। এই ছবি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই বিজেপির অন্দরে যেন শুরু হয়েছে ভীষণ অস্বস্তি। কেউ কেউ একে বলছেন ‘ভূমিকম্প’। এই ছবি সামনে আসার পর দলীয় শৃঙ্খলা, নেতৃত্বের বার্তা ও আদর্শ নিয়েই শুরু হয়েছে তীব্র চাপানউতোর।
আর সেই তর্কের মধ্যেই যেন দিলীপ ঘোষ হয়ে উঠেছেন কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর বিরুদ্ধে তোপ দাগছে দলের একাংশ। আক্রমণের জবাবও দিচ্ছেন দিলীপ ঘোষ তাঁর চিরচেনা ঢঙেই—স্ট্রেট ব্যাটে, স্পষ্ট ভাষায়। তবুও প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে—বিজেপি কি এবার সত্যিই তাঁর বিরুদ্ধে কোনও কড়া পদক্ষেপ নিতে চলেছে?
এই প্রশ্নের উত্তর এখনও পরিষ্কার নয়, তবে সাংবাদিক বৈঠকে বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কথায় কিছুটা ইঙ্গিত মিলেছে। শমীক বলেন, “দিলীপবাবু আমাদের দলের সফল সভাপতি ছিলেন। সাংসদ, বিধায়ক ছিলেন। তিনি কী বলবেন, কী করবেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।” এর সঙ্গেই আবার যোগ করেন, “দল গোটা বিষয়টির উপর নজর রাখছে। যা করার, দল তা করবে সময়মতো। এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন পরিস্থিতি না হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
রাজনৈতিক মহলের মতে, শমীকের এই বক্তব্য নিছকই ব্যক্তিগত মন্তব্য নয়—বরং দলের ভিতরের মনোভাবের প্রতিফলন। দিলীপ ঘোষের সাম্প্রতিক মন্তব্য ও কার্যকলাপ যে দলের অনেকের পছন্দ হয়নি, তা স্পষ্ট। আবার দিলীপও থেমে থাকেননি। টিভি চ্যানেলের স্টুডিয়ো থেকে তিনি নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। জানিয়েছেন, “আমি হিন্দুত্বের কথা বলি। আমার পার্টিও হিন্দুদের কথা বলে। তবে হিন্দুত্বের জায়গা থেকে কি সরে যেতে হবে? আমি কিন্তু কোনওদিন সরে যাইনি।”
এখানেই শেষ নয়। আরও এক ধাপ এগিয়ে তিনি দলের বর্তমান রাজ্য সভাপতির নাম করেই বলেন, “আমার সভাপতি যদি বলতো, আপনি যাবেন না। তাহলে আমি যেতাম না। কিন্তু বিজেপির কেউ তো এমন কিছু বলেনি।” এখানেই যেন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত মেলে—উপরমহলের নীরবতা, আবার নেতার ব্যক্তিগত সক্রিয়তা।
তবে তাঁর কথায় একটা বিষয় স্পষ্ট—তিনি দলের বাইরে নয়, দলের মধ্যেই লড়াই করছেন। তাঁর ভাষায়, “রাজনীতিতে আসার পর থেকেই লড়াই করছি। কখনও বাইরের, কখনও ভিতরের। তবে দলের বিরুদ্ধে লড়িনি কখনও।” একদিকে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখা, অন্যদিকে নিজের মতের উপর অটল থাকা—এই দ্বৈত অবস্থানকে কিভাবে সামলায় বিজেপি, সেটাই এখন দেখার।
এই মুহূর্তে পরিস্থিতি অনেকটাই টানটান নাটকের মতো। কার কী বক্তব্য, কে কাকে ইঙ্গিত করছেন—সবটাই চলছে রাজনৈতিক ইশারায়। দল যেমন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসার আগে সময় নিচ্ছে, তেমনি দিলীপ ঘোষও নিজের অবস্থানে অনড় থাকছেন।
রাজনৈতিক কারবারিদের মতে, এই ঘটনার পর শুধু দিলীপ ঘোষের ভবিষ্যৎ নয়, বরং বিজেপির ভিতরকার শৃঙ্খলা ও নেতৃত্বের ধরন নিয়েও নতুন করে আলোচনা শুরু হতে পারে। প্রশ্ন উঠছে—একক নেতৃত্ব নাকি অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য? দিলীপের মতো হেভিওয়েট নেতাকে সামাল দিতে দল কী পন্থা নেয়, সেই নির্ভর করবে পুরো পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয় তার উপর।
এই মুহূর্তে কিছুই স্থির নয়—না দলের অবস্থান, না দিলীপের ভবিষ্যৎ। তবে যা স্পষ্ট, তা হল বঙ্গ রাজনীতিতে উত্তেজনা এখনও তুঙ্গে। আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখন এমন এক মঞ্চ, যেখানে এক একটি ছবি, এক একটি উক্তিই তৈরি করতে পারে নতুন নাটক, নতুন বিতর্ক।