ভোরের আকাশে উড়েছিল ভারতের আশা-স্বপ্নের রকেট।
সকলের চোখ তখন মহাকাশে। ভারতীয় সময় সকাল ৫টা ৫৯ মিনিট। শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে আকাশে উড়ে গেল পিএসএলভি-সি৬১ রকেট। ইসরোর ১০১তম রকেট উৎক্ষেপণ, আবার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বোঝাই ছিল অত্যাধুনিক আবহাওয়া ও পৃথিবী পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট ‘ইওএস-০৯’।
প্রথম মুহূর্তগুলো ছিল নিখুঁত। উৎক্ষেপণ পর্যায়ে কোনও গোলযোগ ছিল না। বিজ্ঞানীরা আশ্বস্ত ছিলেন, দেশবাসী গর্বিত। রকেটের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু তারপরই ঘটে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তৃতীয় ধাপে গিয়ে থমকে যায় মিশন। ব্যর্থ হল ভারতের EOS-09 অভিযান।
ইসরোর চেয়ারম্যান ভি নারায়ণন জানিয়েছেন, রকেট উৎক্ষেপণের সময় কোনও সমস্যা ছিল না। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে পিএসএলভি-সি৬১ স্বাভাবিক পারফর্ম করেছে। কিন্তু তৃতীয় ধাপে প্রবেশ করার পরই কিছু গুরুতর প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দেয়। যার জেরে ইওএস-০৯ স্যাটেলাইটকে নির্ধারিত কক্ষপথে স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এই কারণে মিশনকে ‘আংশিক ব্যর্থ’ বা ‘অসম্পূর্ণ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ভি নারায়ণন জানিয়েছেন, ঘটনার পর ইসরোর বিজ্ঞানীরা দ্রুত সমস্যার উৎস খুঁজতে তদন্ত শুরু করেছেন। সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত রিপোর্ট খুব শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে।
ইওএস-০৯ ছিল ভারতের এক অত্যাধুনিক উপগ্রহ, যার ওজন প্রায় ১৬৯৪ কেজি। এটি তৈরির মূল লক্ষ্য ছিল দেশের আবহাওয়া পূর্বাভাস, দুর্যোগের আগাম সতর্কতা, কৃষি ও বনজ সম্পদ পর্যবেক্ষণ, নগর পরিকল্পনা, ও জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে নির্ভরযোগ্য উপাত্ত সরবরাহ করা। এটি ছিল একটি অল-ওয়েদার আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট — অর্থাৎ বৃষ্টির মধ্যে, মেঘলা আকাশেও এটি নির্ভুলভাবে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করতে পারত। দেশীয় চাহিদা মেটানোর জন্য ইসরোর এক বিশাল সাফল্য হয়ে উঠতে পারত এই অভিযান।
ইসরো মানেই প্রতিকূলতাকে জয় করার ইতিহাস। চাঁদের মাটিতে সফল চন্দ্রযান-৩, সূর্য পর্যবেক্ষণে আদিত্য-এল১, ভারতের নিজস্ব জিপিএস নেভিগেশন ব্যবস্থা, বিদেশি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে নির্ভরযোগ্যতা, একের পর এক সাফল্য ভারতের মহাকাশ যাত্রাকে বিশ্বের সম্মানিত তালিকায় রেখেছে। সেই ধারাবাহিকতায় আজকের এই ব্যর্থতা এক সাময়িক ধাক্কা বটে, কিন্তু নতুন করে প্রস্তুতির সূচনা বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ ইসরোর প্রতিটি ব্যর্থতা জন্ম দিয়েছে আরও শক্তিশালী ফিরে আসার গল্প।
ইসরো ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, তার জন্য প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ, সফটওয়্যার ও স্টেজ পারফরম্যান্স রিভিউ দ্রুত শুরু করা হয়েছে। ভবিষ্যতের উৎক্ষেপণগুলিকে আরও নির্ভুল করতে ইসরো তৈরি নতুন কৌশল নিতে। এই ব্যর্থতা যেন ভারতের মহাকাশ গবেষণার প্রতি আস্থা না কমিয়ে বরং আরও দায়বদ্ধ করে তোলে বিজ্ঞানীদের, সেটাই বারবার প্রমাণ করেছে ইসরোর অতীত। ইওএস-০৯ মিশন সফল হয়নি, তবে মহাকাশ জয়ের লড়াই থেমে নেই। একটি রকেট থেমে যেতে পারে, কিন্তু ভারতের স্বপ্ন থেমে যায় না।