আজকের প্রজন্ম স্বাস্থ্য সচেতন! সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে চলছে ‘ফিটনেস’ ফিভার, জিম, যোগব্যায়াম, ডায়েট নিয়ে কতই না লেখালেখি। অথচ চিকিৎসা পরিসংখ্যান বলছে, এই আপাতত দৃষ্টিতে ‘সুস্থ’ তরুণ সমাজই আজ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। নেপথ্যে এক নীরব অথচ প্রাণঘাতী রোগ, যার নাম সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক। এই হার্ট অ্যাটাক হয় সাধারণ কোনও যন্ত্রণা বা পরিচিত উপসর্গ ছাড়াই। ফলে রোগী বুঝতেও পারেন না, কখন তাঁর হৃদযন্ত্র বিপদের মুখে পড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা পশ্চিমা দেশের নাগরিকদের তুলনায় দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। আর ভারতীয়রা এই তালিকায় একেবারে শীর্ষে। আরও আশঙ্কার কথা, হৃদরোগে আক্রান্তদের মধ্যে একটি বড় অংশেরই বয়স ৪০-এর নীচে! সম্প্রতি বিখ্যাত অভিনেতা সিধার্থ শুক্লা, প্রখ্যাত গায়ক কেকে, কমেডিয়ান রাজু শ্রীবাস্তব-এর মতো অনেকেই অকালে প্রয়াত হয়েছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। তাঁদের এই পরিণতি চিকিৎসকদেরও ভাবাচ্ছে। কারণ, ফিটনেস সচেতন এবং স্বাস্থ্যবান জীবনযাপনের পরেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁদের।
এই সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক এমন এক ধরনের হার্ট অ্যাটাক, যেখানে হৃদযন্ত্রে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় কিন্তু কোনও ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হয় না। ক্লান্তি, গ্যাস্ট্রিক, পিঠে বা বুকের হালকা টান, এইসবকে সাধারণত গুরুত্ব না দেওয়াতেই মারাত্মক বিপদ ঘটে যায়। অনেকেই কেবল অন্য কোনও কারণে চিকিৎসা করাতে গিয়ে জানতে পারেন যে, তাঁরা আগে কোনও এক সময়ে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন।
সমস্যা এখানেই শেষ নয়। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ভারতীয়দের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণের মধ্যে রয়েছে জেনেটিক প্রবণতা, টাইপ ২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং স্থূলতা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকা, ঘুমের অভাব, মানসিক চাপ, ধূমপান ও মদ্যপানের প্রবণতা। প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসও দিন দিন বিষাক্ত হয়ে উঠছে। শুধু ২০২৪ সালেই সুইগিও জোম্যাটোর মতো ফুড অ্যাপে ১২ মিলিয়নের বেশি সমোসা, প্রতি সেকেন্ডে ২টি বিরিয়ানি ও ২ লক্ষের বেশি চিজ ডিপ ডেলিভারি হয়েছে। এইসব খাবারে থাকা অতিরিক্ত ফ্যাট, লবণ ও শর্করা সরাসরি হৃদরোগের সঙ্গে যুক্ত।
অন্যদিকে, আধুনিক কর্মজীবনের চাপে তরুণরা প্রতিনিয়ত মানসিক দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। দীর্ঘ সময় ধরে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের অতিরিক্ত রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে রক্তনালীর মধ্যে প্লাক জমে ব্লকেজ তৈরি হয়, যা একসময় হার্ট অ্যাটাকের রূপ নেয়। অথচ তরুণরা কোনও লক্ষণ বুঝতে না পেরে সময়মতো চিকিৎসাও করান না। অনিদ্রা, মাথাব্যথা, অতিরিক্ত ক্লান্তি বা বদহজম এইসব হালকা উপসর্গকে পাত্তা না দিয়েই নিজেদের প্রাত্যহিক কাজ চালিয়ে যান। আর শরীরের প্রতি এই অনীহা ভবিষ্যতের বড় বিপদের ইঙ্গিত হতে পারে।
চিকিৎসকরা বলছেন, সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক ঠেকাতে চাই আগাম সতর্কতা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন। নিয়মিত হার্টের সমস্যার পরীক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজন মানসিক স্বস্তি, পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়াম। কিন্তু অতিরিক্ত জিম করা, না বুঝে হেভি ওয়ার্কআউট করাও বিপজ্জনক। কারণ শরীরের ক্ষমতা বুঝে না চললে নিজেই বিপদ ডেকে আনতে পারে ব্যায়াম। অনেকেই ভাবেন, শরীরচর্চা করলেই হৃদরোগ দূরে থাকবে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে সোজা জিমে যাওয়া মোটেই কাজের কথা নয়।
এই প্রেক্ষাপটে ভুবনেশ্বরের সাম আল্টিমেট হাসপাতাল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। হৃদরোগের প্রাথমিক স্ক্রিনিং থেকে শুরু করে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট, পুষ্টিবিদদের পরামর্শ, ব্যায়াম পরিকল্পনা, এমনকি সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং-এর বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। যারা ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে চান, তাঁদের জন্য রয়েছে বিশেষ সহায়তা ও ট্র্যাকিং ব্যবস্থা। এমনকি যাঁদের পরিবারের ইতিহাসে হৃদরোগ রয়েছে, তাঁদের জন্য তৈরি হয়েছে আলাদা প্রিভেনশন প্যাকেজ।
হৃদরোগ প্রতিরোধে দ্রুত সচেতন হওয়া প্রয়োজন। শরীরের ছোটখাটো সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া মানেই বড় বিপদকে আমন্ত্রণ জানানো। কারণ এই সমস্ত ছোট ছোট সমস্যাগুলো হতে পারে বড় সমস্যার প্রাথমিক সংকেত। তাই সময় থাকতে চিকিৎসকের যাওয়া, নিয়মিত হার্ট চেকআপ করানো প্রয়োজন। কারণ একবার হার্ট অ্যাটাক হলে, তারপর সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা বড্ড কঠিন।