সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’
এই ধর্মবিশ্বাস ও বাস্তবের দোলাচলে এবারই প্রথম দিঘার সমুদ্র সৈকতে সরকারি উদ্যোগে গড়াল রথের চাকা। রাস্তার দু’ধারে ব্যারিকেড করে সাধারণ মানুষ বা দর্শনার্থী অথবা ভক্তকুলকে আটকে দিয়ে রথের মূল রশি টেনে রথকে মাসির বাড়ির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন সাধু-সন্ত ও সেবাইতরা। অথচ রথযাত্রায হল একমাত্র ধর্মীয় উৎসব যেখানে ভক্তের ভগবান নিজে রাস্তায় নেমে এসে ভক্তকুলের সঙ্গে মিলিত হন। রথের রশি যা ভক্তির প্রতীক, এই রশিতে টান দিয়ে রথ টেনে ভক্ত তার আরাধ্যের সঙ্গে একাত্ম হন। পুরাণ বা ধর্মীয় তত্ত্ব অনুযায়ী রথযাত্রার মাহাত্ম্য এটাই। অথচ সরকারি উদ্যোগে দিঘার সমুদ্র সৈকতে জগন্নাথ মন্দির তৈরি করে এই প্রথম রাজ্যে
‘শাসকের’ রথ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল। অথচ নিরাপত্তার দোহাই দেখিয়ে রথযাত্রার পরিক্রমায় সেই সাধারণ মানুষ বা ভক্তকুলকে ব্যারিকেড বন্দি করে রথযাত্রা উৎসব উদযাপন করল রাজ্য সরকার।
স্বাভাবিকভাবেই দিঘার যে জগন্নাথ মন্দির এবং রথযাত্রা উৎসব নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল তাতে কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ল তা বলাই বাহুল্য।
যদিও রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এক কিলোমিটার রাস্তায় মাসির বাড়ি যাওয়ার পথে দিঘার জগন্নাথ দেবের রথ যে পরিক্রমা করবে সেখানে বহু মানুষের সমাগম হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। মূলত উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভের ঘটনা এবং গতবছর পুরীতে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে দিঘায় না হয় তা এড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। এর ফলে রথযাত্রার মত বিপুল ভক্ত সমাগমের উৎসব পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দক্ষতা ও সাফল্য যেমন জাহির করা যাবে তেমনি বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ এবং ওড়িশায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা সত্বেও পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের প্রাণহাণির ঘটনা এড়িয়ে রথযাত্রার মতো বড় উৎসব পালন করা সম্ভব এটা দেখিয়ে রাজনৈতিক সাফল্য আদায় করতে পারে রাজ্যের শাসকদল। অবশ্য সেক্ষেত্রে দিঘার জগন্নাথ মন্দির অথবা সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত এই রথযাত্রা উৎসব ‘রাজদম্ভে পূর্ণ’ কিনা তা নিয়েই ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে প্রশাসন ও রাজনীতির অন্দরে। যে ধর্মীয় উৎসবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই কাম্য সেই উৎসবে সাধারণ মানুষ যদি ব্যারিকেড বন্দি হয়ে থাকেন তাহলে ঘটা করে সরকারি কোষাগাড়ের টাকায় যে সুদৃশ্য জগন্নাথ মন্দির তৈরি করেছে রাজ্য সরকার সেই মন্দিরে দেবতার মাহাত্ম্য কি? প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। তাহলে জগন্নাথ যদি জগতের নাথ হন তাহলে দীঘার মন্দিরে কি “আপনারে স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নহে” কবিগুরুর এই অমোঘ বাণী ধ্বনিত হবে? দিঘার ভক্তকুল থেকে এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।