পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ ও রোপা ২০০৯-এর বিরোধিতায় সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন বকেয়া ডিএ মামলায় চূড়ান্ত রায়দানের পর ভবিষ্যতে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মূল ডিএ বা মহার্ঘ্যভাতা মিলবে কি? মামলার গতিপ্রকৃতি এবং সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের মনোভাব নিয়ে ইতিমধ্যেই এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজ্য সরকারি কর্মীমহলে। বকেয়া ডিএ-র পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে এখনো ৩৭ শতাংশ ডিএ পার্থক্য রয়েছে রাজ্যের। সেই পার্থক্য কমিয়ে পরবর্তীকালে ডিএ বা মহার্ঘ্যভাতা কি আদৌ মিলবে? এক্ষেত্রে শুধু রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন নয়, রাজ্য সরকারি কর্মীদের একটি বড় অংশের আন্দোলন বিমুখ হওয়া নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে সাধারণ সরকারি কর্মীদের মনে। বিশেষ করে ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশে ডিএ দেওয়া নিয়ে যে মন্তব্য করা হয়েছে এবং রোপা ২০১৯-এ ডিএ সংক্রান্ত কোনো উল্লেখ না থাকায় ভবিষ্যতে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ পাওয়া নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সরকারি মহলে। বিশেষ করে জেলাস্তরের বা ডাইরেক্টরেটের সরকারি কর্মীদের মধ্যে ডিএ-র ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ দানা বেধেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের সরকারের প্রথম দিনেই সমস্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারী সংগঠনের সঙ্গে মহাকরণের রোটান্ডায় পালাবদলের মূল কান্ডারী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কর্মীদের আর্থিক সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে বৈঠক করেন। সরকারি কর্মীদের কাছে সাময়িকভাবে সহযোগিতার আশ্বাস চেয়ে নেন নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী। ডিএ এবং অন্যান্য আর্থিক দাবি-দাওয়া নিয়ে নতুন সরকার যথার্থভাবে বিবেচনা করবে বলেও আশ্বাস দেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। এক বুক আশা নিয়ে নতুন সরকারকে সর্বতোভাবে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন রাজ্যে সরকারি কর্মীরাও। দুই লক্ষ তিন হাজার কোটি টাকার আর্থিক দেনা মাথায় নিয়ে ক্ষমতার গদিতে বসা নতুন সরকার বছর ঘুরতেই ১০% ডিএ দেয় সরকারি কর্মীদের। যদিও ধীরে ধীরে প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে। প্রথমত সরকারি কর্মীদের ইউনিয়ন করার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এক ছাতার তলায় সমস্ত সরকারি উর্মিলা থাকবেন এই উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। যার মাথায় বসেন রাজ্য সরকারের তৎকালীন সেকেন্ড ইন কমান্ড বর্তমানে জেলবন্দি মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘদিনের পালাবদলের সাধ পেয়ে রাজ্যের অধিকাংশ সরকারি কর্মচারী এই ফেডারেশনের আওতায় চলে আসেন। যদিও আরো তিনটি সংগঠন এক ছাতার তলায় না এসে সমান্তরালভাবে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যান। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ বামপন্থী সংগঠনের সমন্বয় ও অডিনেশন কমিটি এবং রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ফেডারেশন যারা সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন টি এ মামলার মূল উদ্যোক্তা। শুধু ইউনিয়ন করার অধিকার খর্ব করাই নয়, রাজ্যে যেকোন ইস্যুতে বনধ বা ধর্মঘট পালন করার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাজ্য সরকার। এছাড়াও অভিযোগ, রাজ্য সরকারি কর্মীদের শিক্ষা ভাতা পরিবহন ভাতা যেমন তুলে দেওয়া হয়েছে তেমনি বাড়ি ভাড়া ভাতা ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। সচিবালয়ের কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে ১৯৬০ সালের বেতনক্রম ফেরানোর দাবি তুললেও তা আজ পর্যন্ত করা হয়নি। বরং রাজ্য সরকারি কর্মীদের প্রতি হিংসার কারণে সরকারি নিয়ম না মেনে যত্রতত্র বদলি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ প্রকাশ্যে আসার পর ছিন্তার বলিরেখা আরো স্পষ্ট হয়েছে সরকারি কর্মীদের মধ্যে। রাজ্য সরকার তার আর্থিক সংগতি মেনে ডিএ বা মহার্ঘ্যভাতা দেবে কিনা তা ঠিক করবে এবং ডিএ দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্সকে মান্যতা দেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশের উল্লেখ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় তৈরি হয়েছে সরকারি কর্মীদের মধ্যে। সর্বোপরি, রোপা-২০১৯ এ ডিএ বা মহার্ঘ্যভাতার কোনও উল্লেখ না থাকায় চিন্তা আরও বেড়েছে। কারণ রোপা ২০০৯ নিয়ে আদালতে মামলা চললেও রোপা ২০১৯ নিয়ে কোন মামলা অন্তর্ভুক্তি হয়নি। ইতিমধ্যেই ডিএ নিয়ে যারা মামলা করেছেন তারা একই ইস্যুতে দ্বিতীয়বার ফের একই মামলা করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে নতুনভাবে যদি সরকারি কর্মচারী সংগঠনের পক্ষ থেকে রোপা ২০১৯ নিয়ে মামলা করা না হয়। তাহলে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ ভবিষ্যৎ সংকটেই থাকবে বলে মনে করছেন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন ডিএ মামলার মামলাকারীরাই।
বস্তুত, বর্তমানে রাজ্যে দু’লক্ষর হাজার রাজ্য সরকারি কর্মী পদ শূন্য। শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীদের উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ৩ লক্ষ ৯৮ হাজার পদ শূন্য। উচ্চ মাধ্যমিক পরবর্তী স্তরে অনুমোদিত পদের অন্ততপক্ষে ষাট শতাংশ এখনো শূন্য রয়েছে। রাজ্যে কাজের বাজারে কাজ নেই, নিয়োগ বন্ধ অথবা নিয়োগের প্যানেল তৈরি হলে দুর্নীতির পাকে জড়িয়ে তা আদালতের সিদ্ধান্তে বাতিল হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী প্রজন্মের রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ পেতে হলে সরকারি ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে আরও বেশি আন্দোলনমুখী হতে হবে বলে মনে করছেন রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি শ্যামলকুমার মিত্র। তাঁর মতে ,” সরকারি কর্মচারীদের একটা বড় অংশ শাসকদলের ছাতার তলায় রয়েছেন। যারা কর্মীদের দাবি-দাওয়া পূরণে সরকার বিরোধী কোনও আন্দোলনের রাস্তায় হাঁটেন না। কিন্তু সমস্ত কর্মচারীদের মনে রাখতে হবে আন্দোলন ছাড়া কোন দাবি-দাওয়া পূরণ করা যায় না। যদিও আন্দোলন করেও যে খুব বেশি কর্মীদের অধিকার আদায় করা সম্ভব হয়েছে সেটাও ঠিক নয়। সেক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে কর্মীদের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ যে প্রকাশ্যে এসেছে তা আদালতের নির্দেশেই। দীর্ঘ আন্দোলনের পরেও তা কিন্তু সরকারি কর্মীরা ছিনিয়ে আনতে পারেননি। তাই এবার সরকারি খোলস ছেড়ে বেরোতে হবে সরকারি কর্মীদেরই। না হলে ভবিষ্যতে সমূহ বিপদ।” ডিএ মামলার অন্যতম মুখ মলয়কুমার মুখোপাধ্যায়ের মত, ” শুধু সমাজ মাধ্যমে বিপ্লব করে কোন লাভ নেই। রাস্তায় নেমে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে অথবা সরকারকে আদালতের মাধ্যমে মামলায় জর্জরিত করে অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে। না হলে সরকারি কর্মীদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বঞ্চিত থেকে যাবে।” ডিএ মামলার মূল আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য অবশ্য জানিয়েছেন, ” শুধু আদালতের উপর ভরসা করলেই চলবে না। সরকারকে বাধ্য করতে হবে আদালতের নির্দেশ কার্যকর করতে। তার জন্য সরকারি কর্মীদের গণআন্দোলন সংগঠিত করতে হবে।”