যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা…
মহালয়ার সূর্যোদয়ে যখন গঙ্গার ঘাটে ঢেউয়ের সঙ্গে বাজে চণ্ডীপাঠ, তখনই আর এক প্রান্তে বাজে আর্তনাদের নিঃশব্দ সুর। প্রতিমার চোখে আঁকা হয় করুণার রেখা, আর হাসপাতালের বিছানায় ফুটে ওঠে ধর্ষণের দগদগে দাগ। মা দূর্গার আগমনে যেই আলো ফুটে ওঠে রাস্তায় রাস্তায়, সমাজের অন্ধকার কোণগুলো যেন আরও বেশি নিঃসঙ্গ, নিঃশব্দ, আর নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে।
দেবী আসেন, হ্যাঁ। কিন্তু তাঁর আগমনে কি সত্যিই দূর হয় অশুভ? নাকি এই শহর, এই সমাজই এখন অসুরবাহিনীর আশ্রয়স্থল, যেখানে মা দূর্গার ছবি টাঙিয়ে রাখা যায়, কিন্তু নারীর আত্মাকে প্রতিদিন পিষে মারা যায়?
এই রাজ্যেই, যেখানে প্রতিটি মোড়ে দূর্গা, কালী, চণ্ডীর আরাধনা হয়, যেখানে ক্লাবগুলোর থিমে নারীশক্তিকে মহিমান্বিত করা হয়, সেই রাজ্যেই কসবা, আরজিকর, হাওড়া, মালদা কিংবা বীরভূমের অন্ধ কোনে, দিনদুপুরে বা রাতের আঁধারে ধর্ষিত হচ্ছেন একের পর এক নারী।
দেবী মায়ের কাছে শক্তি চাইতে চাইতে কি আমরা ভুলে গেছি, তার রূপ যে প্রতিটি নারীর মধ্যেই বর্তমান? তাহলে কেন সেই নারীর গায়ে লেগে থাকে সমাজের কামনার লালসা? কেন সে ঘরে ফিরতে ভয় পায়? কেন হাসপাতালে গিয়ে ধর্ষিত হয়, বা কলেজ ক্যাম্পাসে হারায় তার নিরাপত্তা?
রাজ্য সরকার বছরে কোটি কোটি টাকা দেয় দুর্গাপুজো উপলক্ষে। ক্লাবগুলো জাঁকজমক করে, ‘মা’ আসছেন বলে। অথচ সেই ‘মা’-রই অন্য এক রূপ, এক মেয়ের আর্তনাদ, থাকতে থাকে রক্তাক্ত বালিশে, আদালতের জেরার ঘরে, পুলিশের ফাঁকফোকর কেস ডায়েরিতে।
এই শহরে দেবী আসেন, কিন্তু অসুরেরা যায় না। তারা থামে না, তাদের মুখে ‘অশুভ শক্তি নাশ করুন মা’ মন্ত্র উচ্চারিত হয় না। তারা ঘুরে বেড়ায় প্রকাশ্যে, রাজনৈতিক পরিচয়, অর্থ, প্রভাব, দলীয় আড়াল! সব মিলিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে।
“চণ্ডী পাঠ” হয়, ‘অসুরদলন’ হয় থিমে, কিন্তু বাস্তবে কি সত্যি তেমন অসুরদলন হয়? না কি এই চণ্ডমুন্ড, মহিষাসুরেরা আজ সমাজের নানা স্তরে, প্রশাসনের ভেতরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য পরিষেবার অলিন্দে, বহুরূপী ছদ্মবেশে লুকিয়ে?
আজ যখন ‘নারী শক্তির বন্দনা’র মাসে ঢাক পড়ছে, তখনই দরকার পড়েছে সত্যিকারের ‘দেবীপ্রতিষ্ঠা’র। কেবল প্যান্ডেলের মূর্তি নয়, নারীর মর্যাদা, নারীর নিরাপত্তা, নারীর ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা, এই হোক প্রকৃত পূজা।
“দুর্গে দুর্গতিনাশিনী, দুর্গতি হর মা”
তোমার আরাধনায় যদি নারী আজও নিরাপদ না থাকে, তবে আমাদের পূজা মিথ্যে, আমাদের বর্ণনা মিথ্যে, আমাদের ঢাক, মন্ত্র, আলোকসজ্জা, সবই এক নির্মম প্রহসন।
মায়ের অস্ত্র যখন শুধুই মণ্ডপের সাজসজ্জা হয়ে থাকে, তখন সমাজের প্রতিটা নারী যেন সেই অসুরের কবলে বন্দি! যার মুক্তি নেই কোনও মন্ত্রে, কোনও দশমীর সিঁদুরে।