পুরুষ বা মহিলা সবার ক্ষেত্রেই মানসিক চাপ বা এক কথায় চিন্তা এখন রোজকার ব্যাপার। এই চিন্তা দেখতে দেখতে এক সময় এমন পর্যায় পৌঁছায় যে তার প্রভাব পড়তে শুরু করে আমাদের ব্যক্তিগত বা কর্মজীবনে। এমনই এক পরিস্থিতির মুখে পড়ে পাগল-পাগল অবস্থা মৌপ্ৰিয়ার। এই জোড়া ফলার চাপে যখন মৌপ্রিয়ার মানসিক উদ্বেগ ক্রমশ বেড়ে চলেছিল তখনএক সহকর্মী তাঁকে ‘ম্যাসাজ থেরাপি’র কথা জানায়। মৌপ্ৰিয়া ‘ম্যাসাজ থেরাপি’ নেওয়ার পর সত্যি সত্যিই এখন অনেকটাই ভাল।
যে কোনও রোগের চিকিৎসার দুটি দিক। এক, ওষুধ যার অর্থ সবাই মোটামুটি বোঝেন কিন্তু ওষুধ ছাড়া যেমন ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ, ওজন কমানো, ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করানোর মাধ্যমেও চিকিৎসা হয়, তা অনেকেরই গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কিছু অনীহা থেকে যায়। এ সব ক্ষেত্রে বহু রোগী উপকার পান। বিনা ওষুধের চিকিৎসার মধ্যে আরেকটি পদ্ধতি হল ‘ম্যাসাজ থেরাপি’। আমরা যখন খুবই স্ট্রেসে থাকি, তখন দেহে অ্যাড্রিনালিন হরমোন বেশি ক্ষরণ হয়। তাতে স্ট্রেস আরও বাড়ে। সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উপরে চাপ পড়ে। ফলে ক্ষতির ভয়ও বাড়ে। এর ফলে দেহে যে প্রতিক্রিয়াগুলি দেখা দেয়, তার মধ্যে রয়েছে বুক ধড়ফড় করা, ঘাম হওয়া, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ। এগুলি কমানোর উপায় হল, স্ট্রেস কমানো। মানুষের মন-মস্তিষ্ক যখন আনন্দে থাকে বা খুশি থাকে তখন দেহে এন্ডরফিন হরমোনের ক্ষরণ বাড়ে, যাকে চলতি ভাষায় বলে ‘হ্যাপি হরমোন’। ‘হ্যাপি হরমোন’ ক্ষরণ যত বাড়বে, তত স্ট্রেস কমবে। চিকিৎসকরা বলছেন হ্যাপি হরমোন বাড়ানোর একটাই উপায় হল মাসাজ। এর ফলে দেহে হালকা, ফুরফুরে একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
‘মাসাজ থেরাপি’ হল এক ধরনের ‘ম্যানুয়াল থেরাপি’ যেখানে শরীরের নরম টিস্যু যেমন পেশী, টেন্ডন, লিগামেন্ট এবং ফ্যাসিয়াকে ধরে রাখা, নড়াচড়া করা এবং চাপ প্রয়োগ করা হয়। এটি স্বাস্থ্যের উন্নতি বা বিভিন্ন অসুস্থতা বা আঘাতের চিকিৎসা জন্য ব্যবহৃত হয়।
কেন এমন অনুভূতি হয়?
ফিজিওথেরাপিস্টরা বলছেন, স্ট্রেসের জন্য আমাদের মাংসপেশি শক্ত হয়ে থাকে। ম্যাসাজের ফলে দেহে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, ফলে পেশি নমনীয় হয়ে ওঠে। তার ফলেই ফুরফুরে অনুভূতি মেলে। মানসিক ভাবে হালকা হয়ে যাওয়ার অনুভূতিও মেলে মাসাজের মাধ্যমে। অবসাদ, স্ট্রেসের সমস্যায় কি ম্যাসাজই সমাধান?
এ ব্যাপারে চিকিৎসকরা বলছেন যে, ম্যাসাজ একটি চিকিৎসা পদ্ধতি হতে পারে, তবে কখনই একমাত্র উপায় নয়। এ ছাড়া কারও স্ট্রেসের তীব্রতা সমস্যার গভীরতার উপর নির্ভর করছে তাঁর কী ধরণের চিকিৎসা প্রয়োজন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “কেউ স্ট্রেসের সমস্যা নিয়ে এলে সরাসরি এমন পরামর্শ দেওয়া হয় না।” কোনও মানসিক রোগীর সমস্যার তিনটি দিক থাকে—বায়োলজিক্যাল, সাইকোলজিক্যাল ও সোশ্যাল।যেমন তিনি কী কী ওষুধ নিয়মিত খান, অতীতের কোনও ঘটনার প্রভাব, ট্রমা, নেতিবাচক চিন্তা—সবই খতিয়ে দেখতে হয়। টেনশন থেকে দেহের উপর প্রভাব পড়ছে কি না, দেখতে হয় তা-ও। কারণ এর জেরে হরমোন্যাল, ইমিউনোলজিক্যাল, ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। বেড়ে যেতে পারে ডায়াবেটিস, রক্তচাপ বা হার্টের রোগ। স্ট্রেস, উদ্বেগ, ডিপ্রেশন বেশি থাকলে ওষুধ এবং সাইকোলজিক্যাল থেরাপির মাধ্যমে প্রথম তার মাত্রা কমানো হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাসাজ রোগীকে মানসিক ভাবে হালকা হতে সাহায্য করে। এটি অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির কার্যকারিতা আরও বৃদ্ধি করে।
তবে ম্যাসাজ করাতে যাওয়ার আগে যে বিষয়টি অবশ্যই দেখে নিতে হবে, তা হল, যিনি ম্যাসাজ করবেন তিনি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ কিনা। তা না হলে হিতে বিপরীত হবার বড় আশঙ্কা। কারণ, মানবদেহ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান ছাড়াই ম্যাসাজ করা হলে, তার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে নার্ভ, টিসু বা পেশি। এ ছাড়া কারও অস্থিসন্ধি, মেরুদণ্ডে ব্যথা থাকলে বিশেষ ভাবে সাবধান হতে হবে। কারও কোনো পুরনো চোট বা চর্মরোগ থাকলে ম্যাসাজ করা উচিত নয়। রক্তচাপ কম বা বেশি থাকলে ম্যাসাজ করা যাবে কিনা, কী ধরনের ম্যাসাজ করা যাবে তা একমাত্র অভিজ্ঞ চিকিৎসকই বলতে পারবেন। কেউ বিশেষ কোনও সমস্যার সমাধান চাইলে কী ধরনের ম্যাসাজ প্রয়োজন তা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অভিজ্ঞ থেরাপিষ্টই ঠিক করতে পারবেন। তাই যে কোনও সমস্যায় ম্যাসাজ পার্লারে না গিয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন আপনার জন্য যে মাসাজ ভাল, অন্যের কাছে তা না-ও হতে পারে। তাই নিজের কী সমস্যা তা আগে খতিয়ে দেখে, তবেই মাসাজের পথে হাঁটবেন।