নদী ও নদীপার সুরক্ষা, নদী ও পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত একগাদা কেন্দ্রীয় আইন রয়েছে। যা বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় কর্তৃপক্ষই। এ ছাড়াও, ভূমি আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধিগুলিও নদী তীরবর্তী জমি এবং নদীর সাথে সম্পর্কিত। নদী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের অধিকার, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ, এবং নদীর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়গুলিও এই আইন ও বিধিগুলির আওতায় আসে।
অথচ সকলের চোখের সামনে অবৈধভাবে বসিরহাট মহকুমার টাকি-হাসনাবাদে ইছামতি নদীর চড় দখল করে গজিয়ে উঠেছে বিলাসবহুল হোটেল-রিসর্ট। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এই পর্যটন কেন্দ্রে ইছামতি নদীর চড়ে বেআইনিভাবে বিলাসবহুল হোটেল গজিয়ে উঠেছে। স্থানীয় প্রভাবশালী শাসকদলের নেতাদের মদতেই এই ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ এলাকার বাসিন্দা থেকে পরিবেশপ্রেমী তথা আইনজীবীদেরও।
নদী (দূষণ, সংরক্ষণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৯ সহ রয়েছে জাতীয় নদী সুরক্ষা কমিশন যারা নদী দখল, দূষণ, এবং অন্যান্য অনিয়ম রোধে কাজ করে এবং সরকারের কাছে সুপারিশ করে। অথচ টাকি রাজবাড়ি সংলগ্ন ইছামতির তীরে তাকালেই দেখা যাবে এই সমস্ত যাবতীয় সরকারি উদ্যোগ ও আইন শুধুই কথার কথা। কার্যক্ষেত্রে তার কোন ভূমিকাই চোখে পড়ে না। আর সরকারি উদ্যোগের এই নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশে কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চুরি হচ্ছে নদীর চর, নদীর পাড়ে তৈরি হচ্ছে বিলাসবহুল হোটেল যেখানে নদীর জোয়ারের জল এসে প্রতিনিয়ত ধাক্কা মারছে আর প্রতিদিনই একটু একটু করে এইসব হোটেলগুলিতে আসা পর্যটক বা সাধারণ মানুষের জীবনহানির আশঙ্কাকে ঘনীভূত করছে। স্থানীয় স্তরে প্রতিবাদ বা আপত্তি হয়েছে বহুবার, নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন সমিতি নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বহুবার স্থানীয় আন্দোলন তৈরির চেষ্টাও করেছে এবং স্থানীয় তথা জেলা প্রশাসনকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং সকলের চোখের সামনে দিনের পর দিন বেড়ে উঠছে আরও বেআইনি নির্মাণ। যা সাধারণ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা আরও ত্বরান্বিত করছে এবং চুরি হয়ে যাচ্ছে নদীর চর ও নদীপাড়।
অভিযোগ উঠেছে, এইসব বেআইনি নির্মাণ তৈরিতে রক্ষকই হয়েছে ভক্ষক। টাকি রাজবাড়ি ঘাট সংলগ্ন বেশ কয়েকটি বেআইনি হোটেল-রিসর্ট তৈরি হয়েছে যে গুলির নির্মাণে প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে রাজ্যের শাসক দলের নেতা তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের প্রভাবশালী কর্মাধ্যক্ষের। এমন কি এই বেআইনি নির্মাণের হোটেলগুলির মধ্যে একটির মালিকানায় রয়েছে টাকি পুরসভাও বলে অভিযোগ মিলেছে। অথচ রাজ্য পুরসভা আইনের ক্ষমতাবলে এই ধরনের বেআইনি নির্মাণ ভেঙ্গে ফেলার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ও ক্ষমতা রয়েছে সংশ্লিষ্ট পুরসভারই। সূত্রের খবর, বাকিগুলিরও মালিক কোনও না কোনও প্রভাবশালী। এখানেই প্রশ্ন উঠছে, পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে কিভাবে টাকি পর্যটন কেন্দ্রে ইছামতি নদীর পার দখল করে এভাবে বিলাসবহুল হোটেল তৈরির অনুমোদন মেলে ? নদীতে জোয়ার এলেই জোয়ারের জল হোটেলের দেওয়ালে প্রতিনিয়ত ধাক্কা মারে। নিয়ম অনুযায়ী জোয়ারের জল নদীর কিনারায় যতদূর পর্যন্ত পৌঁছয় সেখান থেকে অন্ততপক্ষে ৯-১০ ফুট দূরে যে কোনও নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু সেই নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একেবারে নদীগর্ভেই তৈরি হয়েছে সুবিশাল হোটেল। একটি হোটেলের একাংশ হেলে পড়েছে বলেও অভিযোগ। যেকোনো সময় হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা। শুধু মানুষের নিরাপত্তাই নয়, পরিবেশের কথা না ভেবেই এভাবেই বেআইনি নির্মাণ চলছে বলে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশ প্রেমীদের একাংশ। উল্লেখযোগ্য, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে এই সমস্ত বেআইনি নির্মাণকেই হাতিয়ার করে স্থানীয় স্তরে প্রচার অভিযানে নামতে চলছে বিরোধী শিবির।
টাকি রাজবাড়ি সংলগ্ন ইছামতির এই নদীপাড়ের পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখে এবার হাইকোর্টে মামলা দায়ের করার উদ্যোগ নিয়েছেন আইনজীবী তথা পরিবেশপ্রেমী তন্ময় বসু। ইতিমধ্যেই উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যের পরিবেশ দফতর থেকে শুরু করে সেচ দফতর, এমনকি টাকি পুরসভা, বসিরহাট মহকুমা শাসকের দফতরে অভিযোগ আকারে আইনি চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। অভিযোগ গিয়েছে বসিরহাট পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার ও হাসনাবাদ থানার কাছেও। এই সমস্ত নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে আইনজীবীর অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পুলিশ প্রশাসনকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে এইভাবে ইছামতি নদীর পাড়ে তৈরি হচ্ছে বিলাসবহুল হোটেল।
আইনজীবীর দাবি, তাজপুরের ক্ষেত্রে আদালত যেমন পরিবেশ ও পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সমুদ্র তীরবর্তী হোটেলগুলোকে ভাঙার নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক তেমনভাবেই টাকি পর্যটন কেন্দ্রের ইছামতি নদীর কিনারায় তৈরি হওয়া হোটেলগুলোকে ভাঙার নির্দেশ দিক আদালত। এ ব্যাপারেও তিনি অবিলম্বে পদক্ষেপ করবেন বলে জানিয়েছেন। এই হোটেল গুলোকে ভেঙে ফেললে শুধু ইছামতি নদী রক্ষা পাবে তাই নয়, হাজার হাজার পর্যটকদের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করা সম্ভব হবে।