অভিজিৎ বসু: শক্তি ও সঙ্ঘের সমাহারে শমীক ভট্টাচার্য্যের এখন নতুন এক রাজনৈতিক জীবন। একদম আলাদা একটা জীবন। সেই মুরলি ধর লেনের ছোট্টো গলি। সেই চেনা বাড়ী। সেই সময় রাজ্যে সভাপতি তপন শিকদার। একদম দাপুটে রাজ্য সভাপতি বলে কথা তিনি সেই আমলের। বিজেপির তখন বড়ই সুখের দিন। তৃণমূলের সাথে হাত ধরে একসাথে পথ চলা সেই তৃণমুল আর বিজেপি জোটের জুড়ে থাকা সংসার। সেই লাল পার্টির বাম আমলেও তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপির বৃহত্তর জোট এর সুখের একটা সংসার।
সেই দিন আজ আর নেই। সেই আমলের এক যুবক যিনি অনর্গল শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাস বা তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আউড়ে চলেছেন দলীয় কার্যালয়ে বসে। রাজনীতির নেশায় পেয়ে বসার আগেই কবিতার নেশায় তিনি বুঁদ হয়ে আছেন তিনি যে। সেই কবিতা প্রিয় মানুষটি শমীক ভট্টাচার্য্য বিজেপির রাজ্যে সভাপতি হলেন। বলতে গেলে কাঁটার মুকুট পড়লেন তিনি। হাওড়ার পঞ্চানন তলার বাসিন্দা। সংঘের সাথে জড়িয়ে পড়া তাঁর ছোটো বেলা থেকেই। যাঁর ছাত্র জীবন সেই গুয়াহাটির কলেজে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ বা এবিভিপির সদস্য হন তিনি। তবে নিজের মতকে সম্বল করেই তাঁর এই রাজনৈতিক জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। বসিরহাট দক্ষিণ থেকে তৃণমূলকে হারিয়ে বিধানসভার মাঠে তাঁর প্রবেশ। সেই অল্প সময়ের মধ্য কিছুটা হলেও তিনি নিজের এই মতকে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করতে কসুর করেননি।
বসিরহাট দক্ষিণ থেকে উপনির্বাচনে তৃণমূলকে হারিয়ে তখন পর্যন্ত দক্ষিণ বঙ্গ থেকে দ্বিতীয় বিধায়ক ছিলেন শমীক ভট্টাচার্য। ওই কদিনেই পরিষদীয় রাজনীতিতে নিজের জাত চিনিয়েছিলো সে। নতুন সদস্য। কেউ নেই তার গাইড। পথে ঘাটে রাজনীতি , বক্তৃতা আর বিধানসভায় সংক্ষিপ্ত সময়ে নিজের এলাকার মানুষের কথা বলে সরকারের উপর চাপ তৈরি করা কিংবা কোনও বিল বা বাজেট নিয়ে বিতর্কে অংশ নেওয়া একেবারেই ভিন্ন একটা ধারার রাজনীতি করে নিজেকে একটু অন্যভাবে তুলে ধরেছিলেন। সে বিধানসভার নানা প্যাঁচ পয়জারকে রপ্ত করে শমীক ভট্টাচার্য্য এখন বঙ্গ বিজেপির নতুন এক আলোক বাতি। যাঁকে ধরেই জেগে উঠতে চাইছে চাঙ্গা হতে চাইছে এই বঙ্গ বিজেপি। ঘুরে দাঁড়াতে চায় তারা।
তাঁর বক্তৃতা, বাগ্মিতা, তাঁর ভোকাল টনিক দলকে আর কর্মীদের কতটা উদ্বুদ্ধ করে সেটাই এখন দেখার বিষয়। দলের বহু উত্থান আর পতনের সে সাক্ষী। দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য অবিচল। কোথায় কি ঘটছে আর কোন গ্রুপে কে কি বলছে সে সব মাথায় না দিয়েই এগিয়ে চলা তাঁর। আর আজ সেই জন্য হয়তো তাঁর এই রাজ্য সভাপতির পুরস্কার পাওয়া। কিন্তু এই কাব্য প্রেমী শমীক ভট্টাচার্য্যে কি সত্যিই শক্ত হাতে কঠিন হয়ে দলের এই করুণ গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের অবস্থাকে সামাল দিতে পারবেন। না কি তিনি দলের এই অন্তর্দলীয় খেয়োখেয়ি সামলাতে না পেরে আবার শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর কবিতার লাইন আউড়ে বলবেন,
‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও,
মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও,
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।
তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মতো মনে পড়ছে,
সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে।
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও,
এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও,
মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’।
সেই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেই যে বঙ্গ বিজেপির এই নতুন সভাপতি গোষ্ঠীহীন রাজনীতির ময়দানে একা কুম্ভ হয়ে রক্ষা করতে চান এই বাংলাকে। যে সোনার বাংলা শুধুই মা মাটি আর মানুষের বাংলা নয়। যে বাংলা রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের বাঙলা। যে বাংলাকে তিনিও যে বড়ই ভালোবাসেন। তিনিও স্বপ্ন দেখেন এই বাংলায় একদিন নিশ্চয়ই পদ্ম ফুল ফুটবে। সেদিন তাঁর হয়তো মনে হবে শ্যামাপ্রসাদ যা চেষ্টা করেও পারেন নি তিনি হয়তো কিছুটা হলেও করতে পারলেন।
কবিতায় বুঁদ হয়ে সেই কঠিন লড়াই করতে নেমেছেন তিনি বাংলার এই কঠিন রাজনৈতিক ময়দানে। সংঘের শতবর্ষের আগে এই বঙ্গ বিজেপির দায়িত্ব পালন তাঁকে আরও বেশি করে কাজের প্রেরণা দিচ্ছে। এটা নিশ্চিত ময়দান ছেড়ে চলে যাওয়ার পাত্র তিনি একেবারেই নন। শক্তি-সঙ্ঘের এহেন বিরল কম্বিনেশন শমীক। কীভাবে সব পরিস্থিতি সামাল দেয় সে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। সত্যিই কি সে যে তৃণমূল বিসর্জনের ডাক দিয়েছে সেটা কি করা সম্ভব। না কি সবটাই মুখের আওয়াজ। এর উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।