সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়– ৫ জুলাই, ২০১২ । আজ থেকে ঠিক ১৩ বছর আগের এক রাতের ঘটনা। গোবরডাঙ্গা স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে থামে আপ বনগাঁ লোকাল। ট্রেন থেকে নামেন মিত্র ইনস্টিউশনের বাংলার শিক্ষক।অন্যদিন স্টেশনে তাঁকে নিতে আসেন অনেক বন্ধু। কারণ গোটা গ্রাম এই শিক্ষকের নিরাপত্তা নিয়ে খুব চিন্তিত। তাই মাস্টারকে একা চলাফেরা করতে দিত না তাঁর অনুরাগীরা। কিন্তু আজ গ্রামে একটি বিয়ে তাই মাস্টার স্টেশনে কাউকে আসতে বারণ করে দিয়েছেন।
প্রতিদিনের মত বেশ কয়েক জোড়া চোখ সেদিনও তক্কে-তক্কে অপেক্ষা করছিল কবে মাস্টারকে একা পাওয়া যায়। সুযোগ এসে গেল সেদিন। এক নম্বর প্লাটফর্ম থেকে বেরোনোর পর নিজের বাইকে উঠতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় পিছন দিক থেকে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক রেঞ্জে গুলি। দুটি বুলেট, প্রথমে পিঠে তারপর বুকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন সুঁটিয়ার “মাস্টারদা”। প্রায় আধঘণ্টা গোবরডাঙা স্টেশন চত্বরে রক্তে মাখামাখি হয়ে কাতরেছেন। যতক্ষণ দেহে প্রাণ ছিল বলছিলেন, “আমায় বাঁচাও।” না কেউ আসেনি। অনেক পরে খবর পেয়ে ছুটে আসে তাঁর অনুগামীরা। কিন্তু ক্রমাগত রক্তক্ষরণের জেরে শেষরক্ষা হয়নি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সুঁটিয়ার ” মাস্টারদা ” বরুণ বিশ্বাস।
রাতভর কেঁদেছিল গোটা গ্রাম। পরদিন মানে ৬ জুলাই ভারি বৃষ্টিতেও স্থানীয় মাঠে জমায়েত হয়েছিল হাজার, হাজার মানুষের । সবাই প্রিয় মাস্টারদাকে চোখের জলে শেষ বিদায় জানান। তীব্র ক্রোধে ফুঁসতে থাকা স্থানীয় মহিলারা হাতে তুলে নিয়েছিলেন হাতা, খুন্তি, ঝাঁটা । ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি । ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক বন্ধ করে রাখা হয়েছিলো প্রায় ১০ ঘণ্টা। হাজার-হাজার প্রতিবাদী মানুষ অংশ নিয়েছিলেন তাঁর অন্তিম যাত্রায়। মাস্টারদার শবদেহ ছুঁয়ে অনুরগিরা শপথ নিয়েছিলেন দোষীদের সকলের শাস্তি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন। সময়ের সাথে তা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। তাঁর হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়ায় সন্তুষ্ট নন পরিবারের সদস্যরাও।
কে এই মাস্টারদা ? কেনই বা অকালে চলে যেতে হল তাঁকে ? উত্তর খুঁজতে চলে যেতে হবে বেশ কয়েকটা দশক। উত্তর চব্বিশ পরগনার একদম প্রান্তিক গ্রাম সুঁটিয়া। একঘণ্টা হাঁটাপথে বাংলাদেশ সীমান্ত। সুঁটিয়ায় একাত্তরের পর থেকে ওপার বাংলা থেকে এসেছে মানুষের ঢল। প্রতি বছর ইচ্ছামতি-যমুনার জলে সুটিয়া ভেসে যায়। সরকারি-বেসরকারি রিলিফ ফান্ড আসে। এই রিলিফ ধর্ষণ নগরী। ১৯৯০ থেকে ২০০২, সুঁটিয়া এবং তার আশপাশের গ্রামগুলোর দখল নিয়েছিল সুশান্ত চৌধুরী, বীরেশ্বর ঢালিদের দলবল । প্রতি পরিবারের মহিলাদের উপরে নেমে আসে বিষাক্ত ছোবল। সাম্প্রতিক সন্দেশখালির বহুগুণ ভয়ানক ছিল তৎকালীন সুঁটিয়ার মহিলাদের জীবন।
পরিবারের সদস্যদের সামনেই চলেছে যৌন নিপীড়ন । ধর্ষণের পর যোনিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হত বরফ টুকরো । নগ্ন দেহের ছবি তোলা হত। চলতো ভিডিও করে ব্ল্যাকমেল। পরে এই ছবি দেদার বিকোয়। কারুর টু শব্দটি করার যো ছিল না । পুলিশ অভিযোগ নিত না । ছিল দাদাদের অভয় বাণী। যে মেয়েকে ইচ্ছে, তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হত সুখ সাধুর ভিটেতে। সেখানে মজুত অফুরন্ত মদ ও ক্যামেরা । গ্রামে যেকোন বিবাদ- সম্পর্ক জনিত, জমি বা অর্থকরী সংক্রান্ত নিদান একটাই, ধর্ষণ ।
অনেক সময় লাঞ্ছিতা মেয়েটিকে তারা বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে যেত । মেয়েটির মা-কে বলে যেত, মেয়েটিকে তাদের মনে ধরেছে । যেন সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে । পরের দিন আবার নিয়ে যাবে । বাড়িতে বাড়িতে গুন্ডাদের দূতেরা বলে আসত “মেয়ে পাঠিয়ে দেবেন , না হলে সব জ্বালিয়ে দেব।” তৎকালীন সুঁটিয়ার এই ঘটনা যে কোন সিনেমা স্ক্রিপ্টকেও হার মানায়। ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত পুলিশের রিপোর্টে সুঁটিয়ায় ধর্ষণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৩। স্থানীয়দের মতে,আসল সংখ্যা অনেক গুণ বেশি।
ঠিক তখনই কলকাতা মিত্র ইনস্টিটিউটে সদ্য চাকরি পাওয়া ২৬ -২৭ বছরের ছিপছিপে গড়নের এক যুবক সুঁটিয়া বাজারের চৌরাস্তার মোড়ে বৃষ্টি ভেজা এক সন্ধ্যায় মাইক্রোফোন ধরে বলা শুরু করেন “আমরা যদি আমাদের মা বোন মেয়ের সম্মান ক্রিমিনালদের হাত থেকে না বাঁচাতে পারি , আমরা ক্রিমিনালদের থেকে বেশি অপরাধী। ” সুঁটিয়া শুনল প্রথম প্রতিবাদের ভাষা। প্রথম কেউ শিরদাঁড়া টানটান করে জানাল ” ব্যাস অনেক হয়েছে , আর নয় অন্যায়, এবার ন্যায় চাই।” সেই দিনের সেই শিরদাঁড়ার নাম বরুন বিশ্বাস, সুঁটিয়ার “মাস্টারদা”। একটা বরুণ বা সূর্যের উদয় হাজার হাজার বরুণের নিভে যাওয়া আগুনকে জ্বালিয়ে দিল।
নিজের উদ্যোগে মাস্টারদা তৈরি করলেন সুঁটিয়া ধর্ষণ বিরোধী মঞ্চ । পাশে পেলেন বেশ কিছু উৎসাহী ছেলেমেয়েকে। সরকারের উপর মহলে লিখলেন একটার পর একটা চিঠি । ধর্ষিতা মেয়েদের বিয়ে দিলেন । গড়ে তুললেন পাল্টা প্রতিরোধ । রাতের পর রাত বাইকে টহল দিতেন গোটা গ্রাম । তাঁর বাইকের আওয়াজে গোটা গাঁ নিশ্চিন্তে ঘুমোত। গোটা গ্রামে বরুণ ছিলেন প্রত্যেকের ঘরের ছেলে। কার বই কেনা হয়নি , কার টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না , কার ওষুধ চাই , কার কলেজে ভর্তি হতে হবে , সবার মুশকিল আসান মাস্টারদা।
মাস্টারদার একটার পর একটা চিঠি শেষমেষ সরকারের টনক নড়িয়ে দেয়। সিআইডি তদন্ত হলে গ্রেপ্তার হয় সুশান্ত, বীরেশ্বর সহ আরো অনেকে । মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় এদের । কিন্তু মাস্টারদা লড়াই তখনো শেষ হয়নি। ফিবছর গ্রামে বন্যা হয় । কারণ কি ? জানা গেল, ভাটার সময় কেটে নেওয়া হয় মাটি । মাটি-মাফিয়ারা সেই মাটি পাঠিয়ে দিচ্ছে চড়া দামে । ফলে বর্ষাকালে অবশ্যম্ভাবী বন্যা । নতুন বাঁধ, নতুন রিলিফ ফান্ড , নতুন ঠিকাদার-একটা বিরাট, সংঘটিত অপরাধ চক্র । এর বিরুদ্ধে বরুণ শুরু করলেন নতুন লড়াই। মানুষ আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল।
দুষ্কৃতীরা বুঝেছিল বরুণ বিশ্বাসকে চিরতরে না সরালে তাদের সর্বনাশ। আর সেই কারণেই মাস্টারদা’র এই করুণ পরিণতি। ২০১৬, ৩০ জুন ভোররাতে হাবরা, গাইঘাটা ও গোপালনগর থানার পুলিশ অপরাধী চক্রের পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে ছিল অভিযুক্ত ভাড়াটে খুনি সুমন্ত দেবনাথ ওরফে ফটকে, দেবাশিষ সরকার, বিশ্বজিৎ বিশ্বাস ও রাজু সরকার। এদের বেশিরভাগই স্থানীয় দুষ্কৃতি। এরা পুলিশের কাছে স্বীকার করে যে দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী সুশান্ত চৌধুরীর নির্দেশে তারা বরুণ বিশ্বাসকে খুন করেছে | ভাড়াটে খুনিরা ধরা পড়লেও কার বা কাদের অর্থে ও নির্দেশে এ খুন, তার আলোকপাত নেই সিআইডি’র চার্জশিটে। এই হত্যার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে নাম জড়িয়েছে এক বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তির। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে হয়নি কোনও তদন্ত | বরুণের হত্যার নেপথ্যে বড় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ? আজও মেলেনি উত্তর! আজ ঘটনার ১৩ বছর বাদেও প্রকৃত দোষীরা সাজা পাননি । বনগাঁ মহকুমা আদালতে আজও সে মামলা চলছে