কেন একরাতে তিব্বত ছেড়ে পালাতে হয়েছিল তিব্বতের ১৪তম আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামাকে? কেন তাঁকে নিজের দেশ, মানুষ, এবং প্রিয় ভূমি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল? কী বলছে ইতিহাস? ১৯৫৯ সালের ১৭ মার্চ দলাই লামা রাজধানী লাসা থেকে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়েন। প্রায় ১৫ দিন ধরে পাহাড়, উপত্যকা আর নদী পার হয়ে অবশেষে ভারতের অরুণাচল সীমান্তে পৌঁছান তিনি।
ততদিনে তিব্বতে লালফৌজের আগ্রাসন বাড়তে থাকে। দালাই লামা নিজের আত্মজীবনী ‘মাই ল্যান্ড মাই পিপল’ বইতে লেখেন, ১৯৫৯ সালের মার্চে তিব্বতের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে মানুষ ভাবতে শুরু করে, চিন তাঁকে হয়তো বন্দি করে নিতে চাইছে। ১ মার্চ শুরু হয় পবিত্র ‘মোনলম’ উৎসব, কিন্তু উৎসবের মাঝে চিনাদের অদ্ভুত আচরণ সন্দেহের সৃষ্টি করে।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
চিনা অফিসাররা দলাই লামাকে সেনা ক্যাম্পে একা গিয়ে একটি ‘সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’-এ যোগ দিতে বলেন। দালাই লামা ১০ মার্চ তারিখ প্রস্তাব করেন। কিন্তু এরপরই খবর আসে যে তিনি যেন কোনো দেহরক্ষী ছাড়া সেখানে যান, এতেই আশঙ্কা আরও গাঢ় হয়ে ওঠে
৯ মার্চ রাতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, দালাই লামাকে অপহরণ করা হবে। পরদিন, ১০ মার্চ সকালে প্রায় ৩০,০০০ মানুষ তাঁর প্রাসাদ নোরবুলিংকার বাইরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। তাঁরা চাইছিলেন না দালাই লামা চিনা ক্যাম্পে যান। এমন উত্তপ্ত পরিবেশে একদিকে ছিল তিব্বতি জনতার ক্ষোভ, অন্যদিকে লালাফৌজের প্রবল শক্তি, দালাই লামা ছিলেন এক কঠিন সংকটের মুখে।
আরও পড়ুন
চিনের দিক থেকে দমন-পীড়নের হুমকি আরও বাড়তে থাকায় এবং ততদিনে তিব্বতের পূর্বাঞ্চলে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যার খবর পাওয়া যেতে থাকায়, দালাই লামা সিদ্ধান্ত নেন, তাঁকে দেশ ছাড়তেই হবে। দলাই লামা ও তাঁর সঙ্গীরা রাতের অন্ধকারে গোপনে যাত্রা শুরু করেন। দিনের বেলায় বিশ্রাম আর রাতে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে যাত্রা। দুধারে চিনা সেনার টহল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে আবহাওয়া ও মেঘে ঢাকা পড়ে যায় তাঁদের অবস্থান। অনেকে বলেন, এটি ছিল প্রার্থনার ফল।
অবশেষে ৩১ মার্চ, দালাই লামা ভারতের মাটিতে পা রাখেন। তিনি হয়ে যান নির্বাসিত তিব্বতি নেতা, আর তিব্বতের জন্য শুরু হয় নতুন এক সময়, সংগ্রাম, প্রতিরোধ ও আশ্রয়ের। ৬৬ বছর পার হলেও, দালাই লামার দেশত্যাগ আজও বিশ্ব রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ ঘটনা শুধু একজন ধর্মগুরুর দেশত্যাগ নয়, বরং এক গোটা জাতির আত্মপরিচয় রক্ষার লড়াইয়ের প্রতীক।