অভিজিৎ বসু
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে॥
বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো, আউষের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,
কালিমাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে॥
আষাঢ় মাসের এই কবিতার কথায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন কতদিন আগেই। যে বর্ষার ঘন ঘোর রূপ দেখে কবিও নিজেই যেনো কেমন উতলা হয়ে এই লেখা লিখলেন। প্রকৃতির এই অবিরাম বাদল ধারা ঝরে পড়লো তাঁর লেখনীতে। মাঠ ঘাট প্রান্তরের বর্ষণ সিক্ত রূপ দেখে কবির হৃদয় মথিত হলো। উদ্বিগ্ন হলেন তিনি। আসলে বেণু বনের দোলায় কবির হৃদয় দুলে উঠলো। তাঁর কলমে ফুটে উঠলো আষাঢ় মাসের এই রূপের কথা।
যে আষাঢ়ের মেঘমালা, তার গম্ভীর ঘন কালো রূপ আর আজকাল দেখা মেলাই ভার। বলতে কি সেই বিখ্যাত লাইন আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের কথা মনে পড়ে যায়। আসলে ভেজা বর্ষার রূপ,রস,গন্ধ, বর্ন তার স্পর্শ আলাদা। যে বর্ষায় সিক্ত হয়ে শরীর মন কেমন ভালো হয় যায়। গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছা করে আমার।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
ভেজা গাছের ডালে বসে ওই বুড়ো কাক আর তার ঝগড়া করা বুড়ী কাক বউ কেমন কাক চান করে মহানন্দে দুজনে মিলেমিশে একসাথে। জলে ভেজে হাপুস নয়নে। আর সেটা দেখে ভেজা শালিখের ঠোঁটের ডগায় হলুদ মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়ে। আমি তো সেটা দেখে ঘরে বসে মিটি মিটি হাসি আপন মনে।
আর ঠিক সেই সময় দুর ধূসর মাঠের মাঝে সবুজ ঘাসের দল আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে আয় আয়। আমিও কেমন ওই বুড়ো কাকের মত বদলে যাই। খিটখিটে আমি কেমন সিক্ত হই বর্ষার কাঁচা নরম জলে। আসলে ছোটো বেলার কথা মনে পড়ে যায় আমার।
এই ঘোর বর্ষার দিনে অন্ধকার নেমে এলেও কেমন বেশ কাদা মাখা মাঠে একটা গোল বল নিয়ে দৌড়ে বেড়াতাম সবাই মহানন্দে। ভেজা পিচ্ছিল মাঠের মাঝে পড়ে গিয়েও উঠে আবার দৌড়ে সামিল হতাম আমরা সবাই মিলে। সত্যিই কি যে মজা হতো সেই সময়।আর সেই সন্ধ্যার পরে যখন বাড়িতে শঙ্খ বেজে যেত তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলে যেতো। সেই সময় কাদা মেখে ঘরে ফিরতাম আমি ভয়ে ভয়ে। তারপর ভর সন্ধ্যেয় আমি কাঁপতে কাঁপতে চান করে নিতাম চুপি যেনো কেউ টের না পায়।
ইউটিউবেও জাজবাত, আপডেট থাকুন আমাদের সঙ্গে
আসলে এসব মনে পড়ছে এই কারণে যে বর্ষার দাপটে নাজেহাল হতো আমাদের শৈশব সেই বর্ষা তো আজকাল একদম ভ্যানিশ হয়ে গেছে। সাথে সাথে ভ্যানিশ আমাদের ছোটবেলার সেই দিন গুলোও। বর্ষায় সিক্ত হয়ে সেই স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় কাগজের নৌকা করে জলে ডোবা রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া আর অনেক দূর থেকে সেই সাদা কাগজের নৌকার জলযাত্রা দেখে মুগ্ধ হয়ে দুরপানে তাকিয়ে থাকা। এই ছবি আজও অমলিন আমার স্মৃতিতে।
আর সেই যে টোকো মাথায় করে বর্ষায় জলে ভিজে সবুজ ধান বুনতে নামতো যে মুনিশরা ধান জমিতে। কেমন যেনো সব আনন্দ করে কাজ করত তারা হাসি মুখে জলে ভিজে একশা হয়ে এ আর গায়ে ঢলে পড়ে। কোনোদিন তো তাদের মুখে কোনো অভাব অভিযোগ শুনিনি। মুড়ি, আলুর তরকারি আর একটু গুড় গামছায় বেঁধে সকাল থেকে দুপুর অবধি তারা মহানন্দে অপরের জমিতে ধান বুনত কেমন হাসি মুখে। কেমন যেনো একটা বৃষ্টি ভেজা, জলে ভেজা ভালবাসা ছিল জীবনের সেই সময়ে।
আরও পড়ুন
না, এটা কোনো বর্ষার রচনা নয়। জলে ভেজা শৈশবের কথা মাত্র। জলে ভেজা কৈশোরের জোলো প্রেম। আর যৌবনের জল ফড়িং এর তিরতির করে উড়ে বেড়ানোর কথা আর কি। কতদিন যে বর্ষায় ঘরের জানলা দিয়ে বসে লোহার ঠাণ্ডা রডে থুতনি ঠেকিয়ে আকাশ দেখা হয়নি আমার। কতদিন যে রাস্তায় নৌকো ছেড়ে তার চলে যাওয়া দেখা হয়নি। কতদিন যে ভেজা মাঠে জল কাদা মেখে দৌড় দেওয়া হয় নি আমার।
সত্যিই তো জীবনের এই জলে ভেজা রাস্তা আজ যেনো বড়ো শুকনো খটখটে। ভেজা রাস্তার স্বাদ জীবন থেকে আলাদা হয়ে গেছে যেনো বহুদিন হলো। আকাশে আর সেই ঘন কালো মেঘমালার আর দেখা নেই। যে কালো চুল এলিয়ে হাসি মুখে আকাশ জুড়ে বিরাজ করতো সে। দিন রাত করা ঝর ঝর মুখর বাদল দিনের সেই মন কেমন করা ডাক আর নেই। ভেজা মনের গভীরে সিক্ত ভালবাসার স্পর্শও নেই। সত্যিই তো কতই না বদলে গেলো আমার বড়ো প্রিয় সেই আষাঢ়। যে আষাঢ় আমায় ছেড়ে চলে গেছে বহুদিন আগেই।

