জায়গা হয়নি লিডসে প্রথম টেস্টের দলে। এজবাস্টনে জশপ্রীত বুমরাহ্ বিশ্রাম নিতে তবে শিকে ছেঁড়ে আকাশ দীপের ভাগ্যে। আর এক সুযোগেই বাজিমাত। এজবাস্টনে দুই ইনিংসে মিলিয়ে ১০ উইকেট নিয়ে বাংলার হয়ে রনজি ট্রফি খেলা পেসার এখন গোটা ভারতবর্ষের নয়নের মনি। কিন্তু জানেন কি বিহারের প্রত্যন্ত গ্রাম দেহরি থেকে উঠে আসা এই দুর্দান্ত প্রতিভার যাত্রার শুরুটা হয়েছিল কীভাবে? আসলে ঠিক কেমন তাঁর জীবনের গল্পটা?
প্রত্যন্ত বিহার থেকে বার্মিংহাম। এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথে অনেক কিছুই দেখে ফেলেছেন আকাশ। মাত্র ১৮ বছরেই বাবাকে হারান তিনি। এরপর এক বছরের মধ্যেই চলে যান দাদাও। এই জায়গা থেকে উঠে এসে খাস বিলেতের রাজপথে একজন শ্বেতাঙ্গের গানের সাবজেক্ট হয়ে ওঠার কাহিনিটি নিয়ে স্বচ্ছন্দে বানিয়ে ফেলা যায় একটি আস্ত সিনেমা। যেখানে হাসি এবং কান্না থাকবে ঠিক সমানুপাতেই। আকাশ নিজেই একবার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তাঁদের এলাকায় চিকিৎসা পরিষেবা বলতে সেই অর্থে কিছু ছিল না বলেই বাবাকে হারিয়েছেন তিনি। শুধু চিকিৎসা কেন? প্রত্যন্ত গ্রাম দেহরি’র সামাজিক এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক অবস্থানের ছবিটা এতটাই করুণ যে যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আকাশের অভিষেক হয় তখন গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে একটি জেনারেটর কেনেন। যাতে আকস্মিক বিদ্যুৎ চলে গেলেও ঘরের ছেলের খেলা তাঁরা দেখতে পারেন।
আকাশের কাহিনিতে ট্র্যাজিক উপাদানের শেষ এখানেই নয়। বরং এই কাহিনিতে এক বাড়তি মাত্রা যোগ করেছেন ভারতীয় পেসারের দিদি অখণ্ড জ্যোতি সিং। বর্তমানে যিনি কর্কট রোগে আক্রান্ত। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে দিতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে আকাশ নাকি তাঁকে বারবার নিষেধ করেছেন রোগ নিয়ে বেশি ভাবতে। আবার দিদিও ভাইকে পরামর্শ দেন, “তুই নিজের খেলার দিকে মন দে।”
সব মিলিয়ে এ যেন এক রূপকথার গল্প। কিংবা বাংলা সাহিত্যের কোনও এক কালজয়ী লেখকের কলমনিঃসৃত উপন্যাস। আর সেই কারণেই না চাইলেও আকাশের সঙ্গে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির তুলনাটা কোথাও গিয়ে যেন এসেই পড়ে। লম্বা চুলের ধোনি ছিলেন রাঁচি থেকে উঠে আসা এক বেপরোয়া যুবক। আর রাঁচি তখন বিহারের অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রত্যন্ত গ্রাম দেহরি’র সঙ্গে তার কোনও তুলনাই চলে না। আরও বড় কথা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখতে আকাশ দীপকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২৭ টা বছর। সেখানে একই বয়সে ধোনি শুধু ভারতের অধিনায়কই নন, ইতিমধ্যেই জিতে ফেলেছিলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তাই বলে ফেলতেই হয়, যে ধোনির উত্থান নিয়ে এত আবেগাপ্লুত ক্রিকেট মহল, সেই ধোনিকেও যেন ছাপিয়ে গিয়েছেন আকাশ দীপ।
২০১৯ সালে বাংলার হয়ে টি-টোয়েন্টি, লিস্ট এ এবং প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট— তিনটি ফরম্যাটেই অভিষেক হয় আকাশ দীপের। ততদিনে অবশ্য তিনি মোহনবাগানেরও একনিষ্ঠ সদস্য। তবে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপাতে লেগে গিয়েছিল আরও প্রায় পাঁচটি বছর। ২০২৪ সালে ধোনির রাঁচিতেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক ঘটে আকাশের। এ ছাড়া ২০২২ থেকে ২০২৪ বেঙ্গালুরুর হয়ে এবং এ বছর লখনউ সুপার জায়ান্টসের হয়ে আইপিএল খেলেছেন তিনি। তবু মানুষের মনের কাছাকাছি আসাটা বাকি ছিল তখনও। সেটা এনে দিল এজবাস্টনের দুটো স্পেল। আর মানুষও বার্মিংহামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিটেলসে’র সুরে তাঁকে নিয়ে বেঁধে ফেলল জয়গান। এই না হলে আর জীবন!