পিয়ার্লস আগ্রো-টেক কর্পোরেশন লিমিটেড-এর ডিরেক্টর গুরনাম সিং-কে গ্রেফতার করল উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ইকোনমিক অফেন্সেস উইং। বৃহস্পতিবার পাঞ্জাবের রোপার জেলার রূপনগর থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। গুরনাম সিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জমির নামে এবং উচ্চ মুনাফার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় ৪৯,০০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে সংগ্রহ করেছেন। এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন প্রায় ৫ কোটি মানুষ।
নিজেদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন। ১৯৯৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জয়পুরে পিয়ার্লস আগ্রো-টেক নামক এই কোম্পানিটি প্রথমে ‘গুরুবন্ত অ্যাগ্রো টেক লিমিটেড’ নামে রেজিস্টার্ড হয়। এরপর ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর নাম পরিবর্তন করে পিয়ার্লস আগ্রো-টেক লিমিটেড হয়। কোম্পানির সদর দফতর ছিল দিল্লির বরখাম্বা রোডে। অথচ, এত বড় আর্থিক কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন, বিশেষ করে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের অধীনে একটি নন-ব্যাংকিং ফিনান্স কোম্পানি হিসেবে রেজিস্ট্রেশনের কোনও অনুমোদন তারা নেয়নি।
তবু তারা নানা প্রকল্পের মাধ্যমে আমজনতার কাছ থেকে রেকারিং ডিপোজিট ও ফিক্সড ডিপোজিটের নামে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে। বিনিময়ে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হতো জমির আশ্বাস ও একটি রসিদ। বাস্তবে জমি বা মুনাফা কিছুই দেওয়া হয়নি। ইকোনমিক অফেন্স উইং-এর মতে, এই প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চলেছে ভারতের দশটি রাজ্য জুড়ে। তালিকায় রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, আসাম, রাজস্থান, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল, বিহার ও ছত্তীসগঢ়।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
শুধু উত্তরপ্রদেশেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ এবং এখান থেকেই পিয়ার্লস আগ্রো-টেক প্রায় ১৯,০০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ তুলেছে। বিভিন্ন জেলায় যেমন মহোবা, সুলতানপুর, ফাররুখাবাদ ও জলাউন-এ এই কোম্পানির শাখা খোলা হয় এবং প্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষকে জমির লোভে টাকা জমা করাতে উৎসাহ দেওয়া হতো। ইকোনমিক অফেন্স উইং-এর ডিজি নীরা রাওয়াত জানিয়েছেন, গুরনাম সিং ১৯৯৮ সাল থেকে পিয়ার্লস আগ্রো-টেক-এর ডিরেক্টর ছিলেন। পুরো প্রতিষ্ঠানটি একটি ক্লাসিক পঞ্জি স্কিমের ওপর ভিত্তি করে চালানো হতো। প্রথমদিকে পুরনো বিনিয়োগকারীদের মুনাফা ফেরত দেওয়ার জন্য নতুন বিনিয়োগকারীদের টাকা ব্যবহার করা হতো।
এইভাবে ধাপে ধাপে একটি পিরামিড স্কিম গড়ে উঠে, যেখানে প্রতিটি বিনিয়োগকারীকে অন্তত দু’জন নতুন গ্রাহক আনতে বলা হতো। এজেন্টদের মোটা কমিশন দেওয়ার ফলে, তারা আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী সকলকেই এই প্রতারণার জালে টেনে আনত। বিভিন্ন শহরে বড় বড় সেমিনার ও প্রচার অনুষ্ঠান করে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা হতো।
এই ঘটনায় ইতিমধ্যে সিবিআই ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট পিয়ার্লস আগ্রো-টেক-এর বিরুদ্ধে পৃথক মামলা দায়ের করেছে। সিবিআই-এর একটি মামলায় ইতিমধ্যেই পিয়ার্লস আগ্রো-টেক-এর চারজন উচ্চপদস্থ কর্তা জেলে রয়েছেন। ইকোনমিক অফেন্স উইং কনপুর থানায় এই মামলার তদন্ত করছে। এখনও কয়েকজন অভিযুক্ত পলাতক এবং তাদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।
সম্প্রতি, পিয়ার্লস আগ্রো-টেক এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিশেষ অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে ইডি। ইডি তদন্তে জানতে পেরেছে , পিয়ার্লস আগ্রো-টেক লিমিটেড সংগৃহীত বিনিয়োগের অর্থ বিভিন্ন শেল কোম্পানি ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম এমডিবি হাউজিং কমপ্লেক্স প্রাইভেট লিমিটেড। এই কোম্পানিটি নিয়ন্ত্রণ করতেন নির্মল সিং ভাঙ্গুর জামাই হরসতিন্দর পাল সিং হায়ার, যিনি বর্তমানে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রয়েছেন। তিনি ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে মুম্বাই, পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় বহু সম্পত্তি কিনেছেন এই প্রতারণা থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে এবং পরে এসব সম্পত্তিকে বৈধ আয় হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
পিয়ার্লস আগ্রো-টেক-এর প্রতিষ্ঠাতা নির্মল সিং ভাঙ্গু একজন সাধারণ পঞ্জাবি কৃষক পরিবারের ছেলে। বারনালা জেলার বাসিন্দা ভাঙ্গু একসময় দুধ বিক্রি করতেন এবং পলিটিকাল সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করতেন। পরে তিনি কলকাতায় পাড়ি দেন এবং সেখানকার একটি পরিচিত বিনিয়োগ কোম্পানি পিয়ার্লস-এ কাজ শুরু করেন।
এরপর তিনি গোল্ডেন ফরেস্ট ইন্ডিয়া লিমিটেড নামে একটি ভুয়ো সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, যা পরে বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকেই তিনি নিজের কোম্পানি খুলে এই বিশাল প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। উচ্চ মুনাফার লোভে পড়ে দেশের ৫ কোটি সাধারণ মানুষ জীবনভর সঞ্চয় হারিয়েছেন এই ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে। ভারতের ইতিহাসে একটি ভয়ঙ্কর শিক্ষা এই পিয়ার্লস আগ্রো-টেক প্রতারণা কাণ্ড।