কারও কাছে সে পরিচিত ‘ঝাঁকলাই’ নামে। আবার কেউ তাকে বলে ‘ঝঙ্কেশ্বরী’। এমন নানা নামে যার পরিচিতি সে আসলে কেউটে প্রজাতির বিষধর সাপ। বংশ পরম্পরায় প্রতি বছর আষাঢ়ের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে তাকেই দেবীজ্ঞানে পুজো করে আসছেন পূর্ব বর্ধমানের ভাতার ও মঙ্গলকোটের সাতটি গ্রামের বাসিন্দারা। মহাধুমধাম করে শুক্রবার ’ঝাঁকলাইয়ের’ পুজো হল ভাতারের বড়পোশলা, শিকোত্তর, মুকুন্দপুর এবং মঙ্গলকোটের ছোট পোশলা, পলসোনা, মুশারু এবং নিগন গ্রামে।
পূর্বে এই সাত গ্রামে ঝাঁকলাইয়ের অবাধ বিচরণ থাকলেও বর্তমানে ভাতারের বড়পোশলা এবং মঙ্গলকোটের ছোটপোশলা, মুশারু ও পলসোনা গ্রামে এখনও ঝাঁকলাই সাপ দেখা দেয়। এই গ্রামগুলিতে এদিন জ্যান্ত ঝাঁকলাই সাপকেই দেবীজ্ঞানে পুজো করা হল। এলাকার বাসিন্দাদের বিশ্বাস, ঝাঁকলাই বিষধর হলেও সে কাউকে কামড়ায় না। কোনও কারণে কাউকে ছোবল দিলে দেবীর মন্দিরের মাটি তার শরীরে লেপে দিলেই নাক তিনি বিষমুক্ত হয়ে যান। এই বিশ্বাস আঁকড়ে আজও ঝাঁকলাই সাপকে সঙ্গে নিয়েই ঘর করেন এইসব গ্রামের বাসিন্দারা।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, তাঁদের গ্রামে রান্নাঘর থেকে শোবার ঘর এবং গ্রামের মন্দির, সর্বত্রই বিষধর কেউটে প্রজাতির ঝাঁকলাই সাপের অবাধ বিচরণ দেখা যায়। এমনকী গ্রামগুলিতে এই ঝাঁকলাই সাপ নিয়ে অনেক লোককথা প্রচলিত আছে। এলাকার বাসিন্দাদের বিশ্বাস ঝাঁকলাই আসলে ’কালনাগিনী’। লক্ষ্মীন্দরকে লোহার বাসরঘরে দংশন করার পর পালানোর সময় বেহুলা তাকে লক্ষকরে ’কাজললতা’ ছুড়ে মারেন। ‘কাজললতার’ আঘাতে কালনাগিনীর ’লেজ’ কেটে যায়। ঝাঁকলাইয়েরও ’লেজ’ তাই কাটা।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
পলসোনার বাসিন্দাদের কথায় এও জানা যায়, পলসোনা গ্রামে একটা ‘ডাঙা’ আছে। সেই ‘ডাঙার’ নাম ’খুনগোর’। বেহুলার ‘শাপে’ কালিয়াদহের কলনাগিনী মর্ত্যে এসে ’খুনগোর ডাঙায়‘ বসবাস করতে শুরু করে। গ্রামের বাসিন্দা মুরারীমোহন চক্রবর্তীকে স্বপ্নাদেশে কালনাগিনী তার পুজো করার কথা জানায়। আর সেই থেকেই পলসোনা গ্রামে ঝাঁকলাইয়ের পুজো হয়ে আসছে। আরও জানা যায়, ঝাঁকলাইয়ের গায়ের রং কালচে বাদামি।
বলে রাখা প্রয়োজন, যে সব গ্রামে ঝাঁকলাই সাপ দেখা যায় সেইসব গ্রামে সচরাচর অন্য কোনও বিষধর সাপ দেখা যায় না। তবে ঝাঁকলাই রাতে বের হয় না। এমনকী এই সাপ এলাকা ছেড়েও বের হয় না। ঝাঁকলাই নিয়ে গ্রামের মানুষজনের ধর্মীয় বিশ্বাস যাই থাক বিজ্ঞানমঞ্চ বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখতেই আগ্রহী। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের বর্ধমান জেলা কার্যকরী সভাপতি চন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, সাপ ঠাণ্ডা রক্তের প্রাণী, কোনও কারণ ছাড়া সাপ কামড়ায় না। তাছাড়া ধর্মীয় রীতিনীতির কারণে ভাতার ও মঙ্গলকোটের ওই সাতটি গ্রামের মানুষেরা সাপকে বিরক্ত করেন না। তাই উভয়ের মধ্যে সহাবস্থান তৈরি হয়েছে’। চন্দ্রনাথ আরও জানিয়েছেন, দীর্ঘদিনের সহাবস্থানের ফলে ওইসব গ্রামগুলিতে সাপের কামড়ের ঘটনা খুবই কম। তবে এই সাপের বিষ আছে। কামড়ালে হাসপাতালে যেতে হবেই।