নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করলেন টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান এন চন্দ্রশেখরণ। রতন টাটার উত্তরসূরির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়েছে জল্পনা। তবে কি ছাব্বিশের নির্বাচনের আগে টাটা গোষ্ঠীর হাত ধরে বাংলায় আবার বড় বিনিয়োগ আনবেন মমতা? যদিও বাস্তব চিত্র বলছে অন্য কথা। নবান্নে মমতা-টাটা বৈঠক মেনে নিতে পারছেন না সিঙ্গুরের মানুষ।
ভোট বড় বালাই। আর তাই যে সিঙ্গুরকে ঢাল করে টাটাদের গুজরাটের সানন্দে পাঠিয়ে মসনদ দখল করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই টাটার সঙ্গেই ছাব্বিশের ভোটের আগে বৈঠক করলেন মমতা। যদিও মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ তুলছেন সিঙ্গুরবাসী। চাষবাস তো হলই না, টাটার সেই কারখানার জমি এখন জঙ্গলাকীর্ণ। ক্ষমতায় এলে চাষিদের টাটার কারখানার জমি জরিপ করে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু প্রকৃত চাষিদের দাবি, তারা সেই জমি এখনও ফেরত পাননি। জরিপের কাজ আংশিক হয়ে থমকে গিয়েছে। তাই তিন ফসলি ফসল ফলত যে জমিতে, তা ঢেকেছে জঙ্গলে।
২০০৬ সালে সিঙ্গুরে টাটার গাড়ি কারখানার প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তারপরেই টাটা কর্তারা সিঙ্গুরের প্রস্তাবিত জমি দেখতে গিয়ে কৃষকদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। তাদের গাড়ি ঘেরাও করে কৃষকরা দাবি করেন যে, তাদের জমি উর্বর চারফসলি। এই জমি শিল্পের জন্য নেওয়া চলবে না। সরকার অন্য পতিত জমি অধিগ্রহণ করে শিল্প গড়ুক। সেসময়ের সিঙ্গুর সিপিএমের দাপুটে জোনাল সম্পাদক সুহৃদ দত্ত ও দিবাকর দাস সহ অন্য নেতারা কৃষকদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। কৃষকদের বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস ‘সিঙ্গুর কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’ তৈরি করে ফেলে। তৃণমূলের তৈরি করা কমিটিতে কংগ্রেস, বিজেপি এবং বামপন্থী দল এসইউসি-কে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে কংগ্রেস, বিজেপি কমিটি ত্যাগ করে।
এরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে শুরু হয় জোর করে কৃষিজমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন। ইতিমধ্যেই সিঙ্গুরে টাটার গাড়ি কারখানার জন্য রাজ্য সরকার সিঙ্গুরে ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। অন্যদিকে তৃণমূলের নেতৃত্বে কৃষকদের আন্দোলনও তীব্র হয়ে উঠেছিল। যদিও সিপিএম তথা বাম সরকারের পাল্টা দাবি ছিল যে, প্রস্তাবিত কারখানার জমির সিংহভাগই এক বা দুই ফসলি,আর সামান্য কিছু জমি তিনফসলি। কোনও চারফসলি জমি সেখানে নেই। যাইহোক, ‘কৃষি ও শিল্প সমানতালে এগিয়ে যেতে পারলে একটি রাজ্যের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হয়’, এই সত্য মেনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিঙ্গুরে একলাখি ন্যানো গাড়ির শিল্প গড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন,যেখানে রাজ্যের হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার যুবকের চাকরি, কর্মসংস্থান হতে পারতো। কিন্তু তৃণমূলের নাছোড়বান্দা আন্দোলনের জেরে বুদ্ধদেববাবুর শিল্প গড়ার প্রচেষ্টা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়, বেকারদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্রমশ কমতে থাকে।
যদিও সেই সময় শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন রাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গা টাটা গোষ্ঠীকে দেখিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বাঁকুড়ার বড়জোড়া, পুরুলিয়া,খড়গপুর ইত্যাদি নানা জায়গার কথা বলা যায়। পশ্চিমবঙ্গে গাড়ি কারখানা নির্মাণের জন্য যখন টাটা মোটর্স্ আগ্রহ দেখায় তখন সরকার দু’তিনটি জায়গায় কারখানা গড়ার প্রস্তাব দেয় যার মধ্যে খড়গপুরে টেলকোর কারখানার উপযুক্ত অঞ্চলও ছিল। কিন্তু বিমানবন্দরের কাছাকাছি ও কলকাতা মহানগরীর নিকটবর্তী এলাকা সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা তৈরি করায় আগ্রহী ছিল টাটা গোষ্ঠী।
সেই মতন সিঙ্গুরের রাজ্য সরকার দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের কাছে জমি অধিগ্রহণ করার জন্য ময়দানে নেমে পড়ে।
অন্যদিকে সিঙ্গুরের অধিকাংশ চাষি তাদের তিন ফসলি জমি দিতে অনিচ্ছুক থাকার কারণে সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এবং এই আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব দেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় ইতিমধ্যেই এক লাখি ন্যানো সিঙ্গুরে মাটিতে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বপ্নের এক লাখি ন্যানো গাড়ি কোম্পানি টাটাদের পিছু হাঁটতে হয়। আর এবার নবান্নে আবারও সেই টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গেই বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী। ২০২৬-এ বিধানসভা নির্বাচনে সিঙ্গুর ইস্যু কতখানি প্রভাব ফেলবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।