সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
টাকিতে ইছামতী নদীর পাড় দখল করে বেআইনি হোটেল-রিসর্ট নির্মাণের যে অভিযোগ উঠেছিল তাতেই সিলমোহর দিল সেচ দফতর। অভিযোগকারী হাইকোর্টের আইনজীবী তন্ময় বসুর চিঠির উত্তরে সেচ দফতরের তরফেও ওই নির্মানগুলিকে “বেআইনি” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রভাবশালী শাসকদলের নেতাদের মদতেই এই ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ এলাকার বাসিন্দা থেকে পরিবেশপ্রেমী তথা আইনজীবীদের। এনিয়ে JAZZBAAT 24 বাংলায় আমরা অগেই খবর করেছিলাম। হাইকোর্টের আইনজীবী তথা পরিবেশ প্রেমী তন্ময় বসুর অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবার বিস্ফোরক রিপোর্ট দিলেন সেচ দপ্তরের বসিরহাট ডিভিশনের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র।

সেচ দফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী, টাকি রাজবাড়ি ঘাট এলাকায় ইছামতীর পাড়ে যে হোটেল ও রিসর্টগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলি রাজ্য সেচ আইনই শুধু নয় রাজ্য পুরসভা আইন, ১৯৯৩ এর ১১৮ নম্বর ধারাকেও সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করেছে। টাকি পুরসভা অনুমোদিত সাইট প্ল্যান, ব্লু-প্রিন্ট ও ট্রেড লাইসেন্সের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। সেচ দপ্তরের এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ইছামতি নদীপাড়ে এ ধরনের বিলাসবহুল হোটেল বা রিসর্ট তৈরির জন্য বসিরহাট ডিভিশনের সেচ দপ্তরের পক্ষ থেকে কোনও ‘ নো অবজেকশন ‘ সার্টিফিকেট নেয়নি নির্মাণকারীরা।
রিপোর্টে বলা হয়েছে ইছামতীর মত নদী, যে নদীতে জোয়ার-ভাটা খেলে, সেই নদীপাড়ের খাসজমি দখল করে তাকে রায়ত জমিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে যা ভূমি আইনেও ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতাভুক্ত। এই ধরণের নির্মাণ শুধু নদীখাত দখল করেছে তাই নয় জোয়ারের জলের গতি আটকে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যহত করছে। এই দখলদারির ঘটনা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নদী আইনেরও পরিপন্থী। এছাড়াও নদী ও নদীপাড় সুরক্ষা, নদী ও পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত একগাদা কেন্দ্রীয় আইনও এক্ষেত্রে অমান্য করা হয়েছে বলেও বিবেচিত।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
নদী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের সামিল বলেও দাবি করা হয়েছে। সেচ দপ্তরের এই বিস্ফোরক রিপোর্টের পাশাপাশি নদী (দূষণ, সংরক্ষণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৯ সহ জাতীয় নদী সুরক্ষা কমিশনের সুপারিশ লংঘন করেছে এই বেআইনি নির্মাণগুলি। বছরভর এই হোটেল বা রিসোর্ট গুলিতে পর্যটকদের আনাগোনা হয়। যেভাবে নদীর চরিত্র বদল করে ফলে এই বেআইনি নির্মাণগুলি হয়েছে সে ক্ষেত্রে মানুষের জীবন ও সম্পত্তি হানির আশঙ্কা করা হয়েছে সেদ্ধ দপ্তরের রিপোর্টে।
প্রশ্ন উঠেছে, এতকিছু বেআইনি কাজ হওয়া সত্বেও এতদিন স্থানীয় প্রশাসন হাত গুটিয়ে বসে ছিল কেন? টাকি রাজবাড়ি ঘাট সংলগ্ন ইছামতির তীরে তাকালেই দেখা যাবে এই সমস্ত বেআইনি নির্মাণ। যেগুলো যাবতীয় সরকারি উদ্যোগ ও আইন শুধুই কথার কথা বলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অথচ কার্যক্ষেত্রে প্রশাসনিক উদ্যোগ বা ভূমিকা চোখেই পড়ে না। আর সরকারি উদ্যোগের এই নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশে কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চুরি হচ্ছে নদীর চর, নদীর পাড় সকলের চোখের সামনেই।
যে বেআইনি নির্মাণে নদীর জোয়ারের জল এসে প্রতিনিয়ত ধাক্কা মারছে আর প্রতিদিনই একটু একটু করে এইসব হোটেলগুলিতে আসা পর্যটক বা সাধারণ মানুষের জীবনহানির আশঙ্কাকে ঘনীভূত করছে। স্থানীয় স্তরে প্রতিবাদ বা আপত্তি হয়েছে বহুবার, নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন সমিতি নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বহুবার স্থানীয় আন্দোলন তৈরির চেষ্টাও করেছে এবং স্থানীয় তথা জেলা প্রশাসনকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং সকলের চোখের সামনে দিনের পর দিন বেড়ে উঠছে আরও বেআইনি নির্মাণ। যা সাধারণ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা আরও ত্বরান্বিত করছে এবং চুরি হয়ে যাচ্ছে নদীর চর ও নদীপাড়।
আরও পড়ুন
পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে কিভাবে টাকি পর্যটন কেন্দ্রে ইছামতি নদীর পাড় দখল করে এভাবে বিলাসবহুল হোটেল তৈরির অনুমোদন মেলে ? অভিযোগ উঠেছে, এইসব বেআইনি নির্মাণ তৈরিতে সর্ষের মধ্যেই রয়েছে ভূত। টাকি রাজবাড়ি ঘাট সংলগ্ন বেশ কয়েকটি বেআইনি হোটেল-রিসর্ট তৈরি হয়েছে যেগুলির নির্মাণে প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে রাজ্যের শাসক দলের নেতা তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের প্রভাবশালী কর্মাধ্যক্ষের। নদীতে জোয়ার এলেই জোয়ারের জল হোটেলের দেওয়ালে প্রতিনিয়ত ধাক্কা মারে। নিয়ম অনুযায়ী জোয়ারের জল নদীর কিনারায় যতদূর পর্যন্ত পৌঁছয় সেখান থেকে অন্ততপক্ষে ৯-১০ ফুট দূরে যেকোনও নির্মাণ করতে হবে।

কিন্তু সেই নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একেবারে নদীগর্ভেই তৈরি হয়েছে সুবিশাল হোটেল। একটি হোটেলের একাংশ হেলে পড়েছে বলেও অভিযোগ। যেকোনো সময় হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা। শুধু মানুষের নিরাপত্তাই নয়, পরিবেশের কথা না ভেবেই এভাবেই বেআইনি নির্মাণ চলছে বলে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশ প্রেমীদের একাংশ। অভিযোগকারী আইনজীবী তন্ময় বসু জানিয়েছেন, এই বেআইনি নির্মাণগুলি ভেঙে ফেললে শুধু ইছামতি নদী রক্ষা পাবে তাই নয়, বহু পর্যটকের জীবন রক্ষা করাও সম্ভব হবে।