বাংলা ভাষার উপর সন্ত্রাস এবং বাঙালি ভোটারদের জেলে পোড়ার চক্রান্ত হলে ‘দিল্লি চলো’ ডাক দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রয়োজনে আরও একটি ভাষা আন্দোলন করে বিজেপির ” দিল্লি রাজ ” ভাঙার ডাক দিলেন তৃণমূলনেত্রী। এমনকি রাজ্যে রাজ্যে ডাবল ইঞ্জিন সরকার ভাঙারও ডাক দিলেন মমতা। সোমবার একুশের মঞ্চ থেকে বাংলা ভাষা এবং রাজ্যে রাজ্যে বাঙালিদের উপর নির্যাতন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার, বিজেপি শাসিত রাজ্য এবং নির্বাচন কমিশনকে তীব্র আক্রমণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা জানান, বিহারে প্রায় ৪০ লক্ষ ভোটারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাংলাতেও এই কাজ করার চেষ্টা করা হলে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও আন্দোলন করা হবে। ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে যে স্পেশাল রিভিশনের আইন করা হয়েছে সেই আইন বাতিল করে ছাড়বো বলেও হুঁশিয়ারি দেন মমতা। ” বাংলায় এসব হতে দেব না” স্পষ্ট কথা তৃণমূলনেত্রীর। মমতার সাফ কথা ” বিজেপি যতই ষড়যন্ত্র করুক, ওরা বদলে যাবে, বাংলাকে বদলাতে পারবে না।”
একুশের মঞ্চ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সার্কুলার দেখিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন ” বিজেপি সরকার একটা সার্কুলার জারি করেছে যেখানে বলা হয়েছে যাকে সন্দেহ হবে তাকে ডিটেনশন ক্যাম্প করে এক মাসের জন্য আটকে রাখতে পারবে। তাই বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী বহু মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। এটা বিজেপির ষড়যন্ত্র আর নির্বাচন কমিশনের চক্রান্ত।” রাজ্যের জেলায় জেলায় ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করার নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে। একদিকে বাংলা ভাষার উপর সন্ত্রাস চলছে অন্যদিকে বাংলার ভোটার তালিকা থেকে বাংলার ভোটারদের বাদ দেওয়ার চক্রান্ত করা হচ্ছে। মমতার দাবি,” বাংলা এসব মানে না বাংলায় সব মানুষের সমান অধিকার আছে, থাকবে। বাংলায় এসব করা যাবে না।”
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নাম উল্লেখ না করেই তৃণমূল নেত্রী বলেন, “একজন বিজেপি নেতা বলছেন, বাংলায় ১৭ লক্ষ রোহিঙ্গা ঢুকেছে। অথচ জাতিসংঘ তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ। তাহলে ওই বিজেপি না থাকে আমার প্রশ্ন আপনি ১৭ লক্ষ রোহিঙ্গা পেলেন কোথায়? একটু হোমওয়ার্ক করুন।” একুশের মঞ্চ থেকে প্রতিবেশী আসাম ওড়িশাকেও এক হাত নিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। কোচবিহারের রাজবংশী বাসিন্দা কে এন আর সি নোটিশ দিয়ে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে আসাম সরকার। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর গর্জন ” আমাদের রাজবংশী ভাইকে এনআরসি নোটিশ পাঠাচ্ছে আসাম সরকার কোন অধিকারে? কি জবাব দেবেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী? আমার জবাব চাই।”
মমতার পাল্টা কৌশল ” আমাদের সুস্মিতা দেব আসামে এর বিরুদ্ধে লড়াই আন্দোলন করবে। আমরা সবাই মিলে আসামে যাব। দেখি কতজনকে ডিটেনশন ক্যাম্পে ওরা ঢোকাতে পারে।” ওড়িশায় নিজের সম্মান বাঁচাতে এক ছাত্রী যখন দৌড়েছিলেন তখন তাকে ধরে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় বলে অভিযোগ মমতার। সেক্ষেত্রে ওড়িশা সরকার কি জবাব দেবে? তাও জানতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার সোজা কথা, ” বিজেপি শাসিত প্রতিটি রাজ্যে দলিত আদিবাসী তফশিল জাতি ও উপজাতি মানুষজন সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত। এগুলোর জবাব কে দেবে?”
একুশের মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রীকেও পাল্টা জবাব দিয়েছেন ইন্ডিয়া নেত্রী তথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুদিন আগেই দুর্গাপুরে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করেছিলেন রাজ্যে পরিবর্তন হলেই উন্নয়ন হবে। একইসঙ্গে এর রাজ্য থেকে ভিন রাজ্যে ছেলেমেয়েদের চলে যাওয়ার প্রসঙ্গ টানেন মোদি। প্রত্যুত্তরে একুশের মঞ্চ থেকে মমতার জবাব, “ওরা ১১ বছর দিল্লিতে আছেন, কি উন্নয়ন করেছেন? ১১ কোটি চাকরি কই? মানুষের হাতে টাকা কোথায়? উল্টে মানুষকেই জেলে পুরছেন! বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে সাম্প্রতিককালে ১৭ লক্ষের বেশি মানুষ দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে গেছে। আর বাংলায় শিল্প ও উন্নয়নের সহায়ক পরিবেশ থাকার জন্য শিল্পপতিরা শিল্প গন্তব্য হিসেবে বাংলামুখী হচ্ছেন। এটাই মূল পার্থক্য। দেশের বিজেপি সরকারকে কন্ট্রোল করছেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। এটা দেশের লজ্জা। ওদের মুখে এসব কথা মানায় না।” মমতা দাবি করেছেন, ভোটের সময় বিজেপি রাজবংশী মতুয়া এমনকি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ হিন্দু ভাবে। আর কাজ মিটলেই ঘাড় ধাক্কা দেয়। এদের মুখে নীতির কথা মানায় না বলেও দাবি করেছেন মমতা।
এদিন একুশের মঞ্চ থেকে প্রতিবারের মতো নতুন করে লড়াইয়ের শপথ নেন তৃণমূল নেত্রী। দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে তাঁর বার্তা, ” তৃণমূল কংগ্রেস লড়াই আন্দোলনে ফসল। আমাদের লড়াই সংগ্রাম সেদিন শেষ হবে যেদিন দিল্লিতে বিজেপিকে সরিয়ে পরিবর্তন হবে। বাংলা ভাষার উপর সন্ত্রাস ও বাংলার মানুষকে জেলে পুরলে দিল্লি পর্যন্ত লড়াই চলবে। যাঁরা বাংলাকে অসম্মান করেছে তাঁদের বাংলার মানুষ ছাড়বে না।”
এদিনের বক্তব্যে শুধু বিজেপি নয় সিপিএম কেও একহাত নিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। বাংলায় রাজনৈতিক চক্রান্তে বিজেপির গোসল সিপিআইএম ও কংগ্রেস বলেও দাবি করেন তিনি। মমতার কথায়, ” রাম-বাম-শ্যাম একসাথে মিলেছে। এদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই। একসময় সবচেয়ে বড় ডাকাত ছিল এই সিপিআইএম এখন সিপিআইএমের দেখানো পথেই সবচেয়ে বড় ডাকাত হয়েছে বিজেপি।
এরা জোট বেঁধে, বাংলার সর্বনাশ করতে চাইছে। তাই বাংলাকে বাঁচাতে আমাদের লড়তে হবে এদের বিরুদ্ধে।” রাজ্যের ৯৪ টা সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যবাসীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে সেগুলি গ্রাম গ্রামান্তরে গিয়ে মানুষকে বোঝাতে হবে বলে কর্মীদের বার্তা দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে বাংলার মানুষই উপযুক্ত জবাব দেবে ষড়যন্ত্রকারীদের বলেও মন্তব্য মমতার।