অভিজিৎ বসু
শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা
ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;
শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু
কবিতার জন্য এতো রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু
কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।
শুধু কবিতার জন্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
শুধু কবিতার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই স্বীকারোক্তি বোধহয় একমাত্র তাঁকেই মানায়। যিনি কবিতার জন্য অমরত্ব তাচ্ছিল্য করতে পারেন অনায়াসে হাসতে হাসতেই। সেই কবিতার জন্যই বাঁচা কবির। যে কবি প্রেম আর ভালবাসার কথা, বৃষ্টি ভেজা সকাল বা দুপুরের কথা, সেই বসন্তের লাল পলাশের পদাবলী মাখা নিশ্চুপ হাসির কথা, সেই নিস্তব্ধ দুপুরে ডাহুকের বিধুর ডাক, শীতের কুয়াশা মাখা সকালে ভোরের আলোয় আলোকিত ঘর আর দুয়ার, সেই মাঠের ধারে হলুদ বসন্তবৌরীর আনাগোনা, সেই শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় টলটলে কাজল কালো চোখের জলের বিরহী দাগ লেপ্টে লেগে থাকে ঘাসের গোড়ায়। যে দাগ দূর থেকে দেখা যায় না কিছুতেই।
প্রেম আর বিরহ, প্রকৃতি আর পৃথিবী, বসন্ত আর শীত এই সব কিছুই নিয়েই তো কবি ও কবিতার শাখা ও প্রশাখা মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে কবির জীবনের অন্ধকারের পাতালঘরে। যে জীবন কেমন এলোমেলো, এলেবেলে আর বিন্দাস জীবন। যে কবি কবিতায় খুঁজে পায় আনন্দ ও দুঃখ। নিজেকে সঁপে দেয় কবিতার সেই দীর্ঘ ট্রাম লাইন এর মধ্যে যেখানে তাঁর জন্ম আর যেখানে তাঁর মৃত্যু। যে কবিতায় মগ্ন হয়ে মিশে যান তিনি শিউলি ঝরা ভোরের শিশির ভেজা এক সকাল বেলায়। যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কবি একা একাই যাপন করেন দিন, চৈত্রের মগ্ন উদাসী হাওয়া গায়ে মেখে কেমন বাউন্ডুলে হয়ে, আত্মমগ্ন হয়ে, শুধু ভেবে আর ভেবে যে ভাবনা একমাত্র কবিদের ভাবনা সাধারণ মানুষের ভাবনা নয়।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
যে ভাবনার জালে নিজেকে বেঁধে ফেলতে কেমন সহজেই পারে এই কবিরা। যে কবিদের আজ কাল খুব বিশেষ একটা দেখাই যায় না বা তাঁদেরকে কেউ দেখতেও যায় না। পরিযায়ী শ্রমিকের কিছু দেখা মেলে কিন্তু অনেক কিন্তু কবিদের দেখা পাওয়া ভার। সদ্য কলকাতায় এক কবিতা পাঠের আসরে শুনলাম দু চারজন বিখ্যাত কবি বা কলম পিষিয়ে হাজির থাকলেও সেই কবিতা পাঠের আসরে শ্রোতা একদম কিন্তু হাতে গোনা ছিল মেরেকেটে কুড়ি জন। কেউ কেউ লিখলেও কে আর শুনবেন সেই অবনী বাড়ি আছো বলে দরজায় যতই ধাক্কা মারুক এই প্রজন্মের নব্য কচি কচি কবিরা।
যে কবিরা রক্ত মাংসের গন্ধ মাখা এক মানুষ। কিন্তু আজকাল এই কর্পোরেটের যুগে কবি আর কবিতা পাঠ বোধহয় কিছুটা প্রস্তর যুগের ব্যবহার্য জিনিস বলেই ধরা হয় আজকাল আমাদের এই মুঠোফোনের যুগে। সেখানে এই কবিতাকে আঁকড়ে ধরেই মেঘ বালিকার মতই বেঁচে থাকা আর এই বিশ্বকবির দেশে শান্তিনিকেতনে কবিতা পাঠের আসরে লিপিকা প্রেক্ষাগৃহে অংশ নেওয়া। সত্যিই বেশ ভালোই ব্যাপার কিন্তু। নানা ভাষায় নিজের লেখা কবিতাকে ভালোবেসে পাঠ করে বলে দেওয়া, না না, কবিতাকে ছুটি দেবার প্রশ্নই ওঠে না একদম।
ইউটিউবেও জাজবাত, আপডেট থাকুন আমাদের সঙ্গে
তাই কবিতা পাঠ শেষে বাংলা নিয়ে পড়ে গবেষণা করা এক ছাত্র শিবনাথ দত্ত হাসতে হাসতে বলে দেয় বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় হাসনুহানার গন্ধ গায়ে মেখে কবিতাকে ভালোবেসে জীবন কাটিয়ে দিতে একটুও থমকে দাঁড়িয়ে ভাববেন না তিনি কোনোদিন, কারণ এটা যে তাঁর ছোট বেলার প্রথম প্রেম। কবি রিম্পি বর্ষায় পাঠভবনে বৃষ্টি ভেজা দুপুরের কথা মনে রেখে বর্ষার রূপকে মনে রেখেই ভিজে ভিজে স্নাত হয়ে কবিতার লাইন লিখে ফেলেন তিনি। মনে পড়ে যায় তার সেই ফেলে আসা বর্ষার দুপুরের কথা। যে পাঠভবনের বৃষ্টি ভেজা দুপুরে তার শরীর আর মনকে আজও ছুঁয়ে যায় এতোদিন পরেও।
আরও পড়ুন
আর তাই বিশ্বভারতীর ভাষা ভবনের পোয়েট্রি ক্লাব ও সপ্তর্ষি প্রকাশন-এর উদ্যোগে গ্রন্থ প্রকাশ ও কবিতা পাঠের আসর অনুষ্ঠিত হলো লিপিকা প্রেক্ষাগৃহে। যে অনুষ্ঠানে অতনু শাশমলের কবিতা সংগ্রহ প্রকাশ করা হয়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটো গল্প প্রকাশ করা হয়। যেখানে কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি নয় যেখানে কবিতা তোমায় হৃদয়ে নিলাম মুঠি। মুঠো ভরে কবিতাকে তুলে নিয়ে এই কঠিন কঠোর জীবনে কবিতাকে আঁকড়ে ধরেই যে কবিদের কবিতার মধ্যেই বেঁচে থাকা। বেঁচে থাক কবিতা পাঠের আসর, বেঁচে থাক কবি ও কবিতা। যে কবিতায় জন্য সব কিছুই ত্যাগ করা যায়।