সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
ভাষার ভিত্তিতে বহুত্ববাদী চেতনা খর্ব করার প্রতিবাদ এবং ভাষার ভিত্তিতেই ভোট রাজনীতির ভরকেন্দ্র বদলের প্রচেষ্টাকে আঘাত করার লক্ষ্যেই একুশের জয়গান। সোমবার কলকাতায় ‘৯৩-এর একুশের মঞ্চ যেন নতুনভাবে ‘৫২-র দুই বাংলার একুশের ভাষা শহিদ মঞ্চের প্রতিরূপ হতে চলেছে। যে বাঙালির হাতের ছোঁয়ায় দেশের সংবিধানের প্রচ্ছদ, জাতীয় সংগীত থেকে জাতীয় মন্ত্র সেই বাঙালি ও বাংলা ভাষাই এখন অস্তিত্বের টানাপোড়েনে ভোট রাজনীতির ভরকেন্দ্রে। তাই বাংলা ও বাঙালি অস্মিতাকে হাতিয়ার করে বাঙালির জনজাগরণের ডাক দিয়ে রাজনীতির ভরকেন্দ্রকে অনুকূলে রাখতে মরিয়া কলকাতার একুশের মঞ্চের কাণ্ডারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলা ভাষা মানেই ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। বাঙালি নবজাগরণের সঙ্গে গোটা দেশে এই ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ সেই বাংলা ভাষাকেই ধর্মের নিক্তিতে মেপে ‘ভিনদেশি’ বলে চিহ্নিত করার অভিযোগ উঠছে! ভাষার ভিত্তিতেই ‘নিজভূমে পরবাসী’ চিহ্নিত করে ভোটাধিকারের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে যোগ্য ভোটারদের বঞ্চিত করার চেষ্টা চলছে বলেও প্রতিবাদ চলছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরে ইতিমধ্যেই এই অভিযোগের ভিত্তিতে সোচ্চার হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
২৬ এর নির্বাচনকে মাথায় রেখে এবার নিজের রাজ্যে ভোট রাজনীতির এই ‘বাঙালি সত্তা’ নিজের অনুকূলে রাখতে একুশের মঞ্চ থেকেই রাজনৈতিক বার্তা দিতে চলেছেন তৃণমূলনেত্রী। বিহারের মতো ভোটার তালিকার SIR চালু করে বাংলার যোগ্য ভোটারদের বঞ্চিত করার ” রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ” করা হচ্ছে বলেও সোচ্চার হয়েছে তৃণমূল।
এক্ষেত্রেও বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্তার আবেগকে পুঁজি করে বাংলার মানুষের ভাবাবেগ নিজেদের সমর্থনে ধরে রেখে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র বজায় রাখতে মরিয়া তৃণমূলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী। ভারতের মতো বহুত্ববাদী দেশে যেখানে আজও কোন স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা নেই, সেখানে বাংলা ভাষা ও বাঙালী জাতিসত্তা যেভাবে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের রাজনীতির অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাতে এবারের একুশের মঞ্চ যে ‘ভাষা শহীদ’ মঞ্চের মতই বাঙালি জাগরণের একটু তৈরি করবে তা বলাই বাহুল্য।
সোমবারের একুশের মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্তা শুধু নয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ক্ষুন্ন করে বাংলার অধিকার খর্ব করার বিষয় নিয়ে সোচ্চার হবেন বলে জানা গেছে। বাংলার মানুষের বঞ্চনা, তাঁদের ন্যায্য অধিকার না দেওয়া, রাজ্য রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে ডান-বাম-রাম একজোট হওয়া, কেন্দ্রীয় বঞ্চনার পাশাপাশি রাজ্যের সরকারি প্রকল্পের সুফল এবং সর্বোপরি মানুষের পাশে থাকার বার্তা দিতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।রাজ্যের শাসক দল সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একুশের মঞ্চে মমতার সম্ভাব্য বার্তা –
বাংলা ভাষার লাঞ্ছনা ও বাঙালিদের ওপর অত্যাচার
বাংলাভাষী মানুষজন বিশেষ করে ভিন রাজ্যে কাজ করা বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার বা নির্যাতনের ঘটনায় সোচ্চার হবেন তৃণমূল নেত্রী। মূলত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে একের পর এক এই ধরনের ঘটনা হওয়ায় এর পিছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রই দেখছে তৃণমূল। বিশেষ করে বাংলায় কথা বললেই তাকে বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিত করা নিয়ে ইতিমধ্যেই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পথে নেমেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দক্ষ বাঙালি শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হবে আর তাদের ওপরে অত্যাচার করা হবে এটা মানা যাবে না বলেঊ জানিয়েছেন তিনি। সুতরাং একুশের মঞ্চ থেকে প্রত্যাঘাত এবং বাংলা ও বাঙালির আবেগ রক্ষার বার্তা দেবেন তৃণমূলনেত্রী।
ভোটার তালিকার সংশোধনে SIR বিরোধিতা
বিহারে আসন্ন নির্বাচনে ভোটার তালিকা সংশোধনে স্পেশাল ইনটেন্সিভ রিভিশন করা নিয়ে সবার আগে সোচ্চার হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেছে বেছে যোগ্য ভোটারদের ভোটাধিকারের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে এই পদ্ধতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন হলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে কমিশনকে ‘বিজেপির এজেন্ট’ বলেও কটাক্ষ করেছেন। এ রাজ্যেও বিহারের ধাঁচেই SIR করা হবে বলেও জানিয়েছে কমিশন। এই পরিস্থিতিতে ১৯৯৩-এর প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে গণ-আন্দোলনের ডাক দিতে পারেন তৃণমূলনেত্রী। এক্ষেত্রে বাঙালি যোগ ও ভোট রাজনীতি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আরও পড়ুন
ধর্মীয় মেরুকরণের অভিযোগে ডান-বাম-রাম জোট
ধর্মীয় মেরুকরণের কারণেই তৃণমূলের মূল প্রতিপক্ষ বিজেপি হলেও প্রধান বিরোধীদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে কংগ্রেস ও সিপিআইএম। এই দাবি করে রাজ্যে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে চতুর্মুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনাকে জোরদার করবেন তৃণমূল নেত্রী। বিজেপির ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি এবং বাম-কংগ্রেসের নীতিহীনতার কথা মানুষের কাছে তুলে ধরার বার্তা দেবেন মমতা।
রাজ্যের প্রাপ্য বকেয়ায় কেন্দ্রীয় বঞ্চনা
আবাস থেকে জলস্বপ্ন প্রকল্প, এমনকি ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কেন্দ্রের টাকা বন্ধ। পাশাপাশি বেশ কিছু প্রকল্পের টাকা দেওয়ার ব্যাপারে হিন্দির উদাসীনতা নিয়ে সোচ্চার হবেন তৃণমূল নেত্রী। কেন্দ্রীয় বঞ্চনা সত্ত্বেও রাজ্যের সরকার বা শাসক দল নিজেদের উদ্যোগে মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াই চালানোর পাশাপাশি উন্নয়নকে কিভাবে তলান্বিত করছে। তারও ব্যাখ্যা দেবেন মমতা। বাংলা ও বাঙালিদের নিয়ে রাজনীতি করার পাশাপাশি বাংলার মানুষের ন্যায্য পাওনা ও অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে হিন্দি বিজেপি সরকার কতটা নেতিবাচক একুশের মঞ্চ থেকে তা জানাবেন মমতা।
ডিভিসির জল ছাড়া ও ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান
“নিজেদের বাঁচাতে বাংলাকে ডোবাচ্ছে”। ইতিমধ্যেই বিবিসিকে উদ্দেশ্য করে এই মন্তব্য করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যকে না জানিয়ে বারংবার ডিভিসি জল ছেড়ে দেওয়ায় প্লাবিত হচ্ছে রাজ্যের একাধিক জেলায় নষ্ট হচ্ছে বহু সম্পত্তি, একের পর এক ভেসে গেছে কৃষি জমি ক্ষতি হয়েছে ফসলের, ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছেন বাংলার গ্রামীণ মানুষজন। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীকে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেও যেমন কোন কাজের কাজ হয়নি তেমনি রাজ্যের বন্যা ত্রাণে এতোটুকু সাহায্য করেনি কেন্দ্র সে কথাও একুশের মঞ্চে তুলে ধরবেন তৃণমূল নেত্রী। পাশাপাশি ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কেন্দ্রের উদাসীনতার অভিযোগ তুলে রাজ্যে নিজের উদ্যোগের কথা একুশের মঞ্চে জানাবেন মমতা।
ইউটিউবেও জাজবাত, আপডেট থাকুন আমাদের সঙ্গে
রাজ্য সরকারি প্রকল্পের উপকারিতা
রাজ্যের প্রাপ্য নিয়ে কেন্দ্র যতই বঞ্চনা করুক রাজ্যবাসী তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না। এই আশ্বাস দিয়ে রাজ্য সরকারের নিজস্ব প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যবাসী কিভাবে উপকৃত হচ্ছেন একুশের মঞ্চ থেকে তা বোঝাবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাব্বিশের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে আরো বেশি সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ঘোষণা করতে পারেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
মানুষের পাশে থাকার বার্তা
ভোট-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হলো সাধারণ মানুষ। এ কথা বিলক্ষণ জানেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ধরে রাখতে সংসদীয় রাজনীতিতে “মানুষই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী”। সেকারণে প্রতিবারের মতো এবারও একুশের মঞ্চ থেকে নেতা-মন্ত্রী ও কর্মীদের মানুষের পাশে থাকার বার্তা দেবেন তৃণমূলনেত্রী।