সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
‘মানুষই শেষ কথা বলে।’ সংসদীয় রাজনীতির এই আপ্তবাক্যটি বিলক্ষণ জানেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের বক্তব্যেও হামেশাই একথা বলেন মমতা। তাই ফিবছর নির্বাচনের আগে মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত কর্মসূচির ঘোষণা করেন মমতা। একুশের আগে ২০২০ সালের পয়লা ডিসেম্বর ‘দুয়ারে সরকার।’ এবার ছব্বিশের আগেই ‘ আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান ‘ নামে নয়া প্রকল্প যাকে দুয়ারে সরকারের
‘ মিনিয়েচার ‘ বা ‘ ক্ষুদ্র সংস্করণ ‘ বলা যেতেই পারে। অর্থাৎ নির্বাচনমুখী বাংলায় দুয়ারে সরকারের পর এবার ‘ আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান ‘। তিনটি বুথ পিছু একটি করে সরকারি ‘সমাধান ক্যাম্প’। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, ” আর সরকারের কাছে আপনাদের আসতে হবে না, সরকার আপনাদের কাছে যাবে।”
প্রসঙ্গত, রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকেই তো প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মহাকরণ থেকে নয়, মানুষের কাছে রাজ্যের সরকারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেন পালাবদলের সরকারের প্রথম দিনেই। প্রথম ১০ বছর নিয়মিতভাবে জেলায় জেলায় গিয়েছে মহাকরণ বা নবান্ন। দ্বিতীয়বার নির্বাচনে যাওয়ার আগেই দুয়ারে সরকার প্রকল্প চালুর পাশাপাশি দিদিকে বলো, সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী ইত্যাদি একাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রাম থেকে শহরের সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কর্মসূচি নিয়েছেন পরিবর্তনের মুখ্যমন্ত্রী।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
একুশেও জয়ধারা অব্যাহত রেখে জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকের কর্মসূচিতে কিছুটা ভাটা পরলেও ‘ দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প শাসক-মানুষ নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখতে কার্যকরী ভুমিকা নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ” ১০ কোটি মানুষ দুয়ারে সরকারের আওতায় এসেছে। এখনও পর্যন্ত ৯০% কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে।” এখানেই প্রশ্ন, আরও একটা নির্বাচনের আগে নতুন করে একই ধাঁচে ফের একটা সরকারি প্রকল্পের তড়িঘড়ি ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা কেন?
রাজ্যে ইতিমধ্যেই ছাব্বিশের ভোটের দামামা বেজেছে। আর নির্বাচন মানেই মানুষের কাছে দরবার, এটা সাধারন মানুষ বুঝুক না বুঝুক রাজনৈতিক দলগুলো বিলক্ষণ বোঝে। তাই আগে থেকেই ভোট রাজনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত রাখে তারা। নবান্নর এই নয়া কর্মসূচি তাঁরই অঙ্গ বলে মনে করছে প্রশাসনিক মহলেরই একাংশ। রাজ্যে ভোটের বুথের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। আর প্রতি তিনটি বুথ নিয়ে একটি ক্যাম্প অর্থাৎ প্রায় ২৭ হাজারের কাছাকাছি এই পাড়ায় সমাধান ক্যাম্প করবে রাজ্য সরকার।
আরও পড়ুন
রাজ্যের শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকা রাজ্য সরকারি কর্মী ফেডারেশনের সদস্য সংখ্যা লক্ষাধিক। এই অনুগত সরকারি কর্মীদের জেলায় জেলায় কাজে লাগিয়ে ছাব্বিশের পরীক্ষায় বসতে চান মুখ্যমন্ত্রী বলেও মনে করা হচ্ছে। মানুষের মন বুঝতে পাড়ায়-পাড়ায় ক্যাম্প তৈরির চেষ্টা বলে মনে করছেন বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ। বিপক্ষের যুক্তি, ছোট ছোট যে সমস্যার কথা মুখ্যমন্ত্রী বলছেন তা করার জন্য স্থানীয় স্তরে পঞ্চায়েত অথবা পুরসভা রয়েছে। পঞ্চায়েতের ত্রিস্তরে সেই কাজগুলি দেখাশোনার দায়-দায়িত্ব নির্দিষ্ট সরকারি পরিকাঠামো অনুযায়ী বিন্যস্ত রয়েছে।
দুয়ারে সরকার প্রকল্পের মাধ্যমে নব্বই শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে বলেও দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তা সত্ত্বেও সরকারি ব্যবস্থাপনায় পাড়ায় পাড়ায় এ ধরনের ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ” – এর মত কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ। প্রশাসনের নিচুস্তরে বা শাসকদলের তৃণমূল স্তরে ভরসা করছে না নবান্ন? রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে এই প্রশ্নও উঠেছে প্রশাসনের অন্দরে।
যেহেতু ছাব্বিশের নির্বাচনে এখন থেকেই দুর্নীতি ও অনুন্নয়নের পাশাপাশি বাংলা ভাষা বা বাংলাদেশী এবং ভোটার তালিকা অন্যতম প্রধান ইস্যু হতে চলেছে সে কারণে গ্রাম গ্রামান্তরে পাড়ায় পাড়ায় সরকারি মেকানিজমকে কাজে লাগিয়ে ভোটের পরিবেশ এবং ভোটারদের হাল- হকিকত জেনে পুরনো কর্মসূচিকে নতুন মোড়কে বেঁধে মানুষের আরও কাছে পৌঁছতে চায় রাজ্যের শাসক দল বলেও রাজনৈতিক মহলের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে।
” ছোট সমস্যার সমাধানে মানুষ খুশি হয়। সরকার ছোট ছোট ক্ষেত্রেও তাদের কথা মাথায় রেখেছে এটা তাঁরা বুঝতে পারেন। এই কর্মসূচি মূলত উপর থেকে নয়, নিচে নেমে মানুষের কথা শোনা” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্যের মধ্যেই সেই রাজনৈতিক ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে দাবি একাংশের।