আসলে রাজনীতির এই ময়দানে কে কাকে ছাপিয়ে যাবেন আর কতটা ছাপিয়ে যাবেন সেটার ওপর নির্ভর করে কে কাকে টপকে যাচ্ছেন আর কতটা টপকে যাচ্ছেন তার উপর। এই টপকে যাওয়ার খেলাটা কিন্তু বেশ মজার। এক সময়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল থাকাকালীন জগদীপ ধনখড় জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ভাজা ভাজা করে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে। প্রতিদিন আর প্রতি মুহূর্তে এই লড়ছি আমরা দেখো তোমরা। এই স্লোগান দিয়ে রাজভবনে লড়াই করছেন আর দিল্লীকে বলেছেন, দেখো তোমরা। আমি কি করতে পারি আর কতটা করতে পারি তোমাদের জন্যে। যা দিল্লীতে বসে এই বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী তথা অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টাইট দিতে পারো না তোমরা। আমি কিন্তু সেটাই এই বঙ্গে রাজভবনের শীততপ নিয়ন্ত্রিত ঘর থেকেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু করতে পারি একটা। যে খেলা আমার মাদারিকা খেল ছাড়া আর কিছুই নয়।
সেই খেলা খেলতে খেলতে তাঁর প্রমোশন পেয়ে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবেও আমি কত বড় বিজেপি বা আরএসএস, সেটার প্রমাণেই মরিয়া ছিলেন তিনি। একেবারেই সরাসরি কাউকে কর্পোরেট চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া তাঁর। আর এই বেড়ে খেলতে গিয়েই বিপাকে দেশের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়। কিছুদিন ধরেই নানা কারণে তিনিই মোদি-শাহের চক্ষুশূল। আর শেষ পর্যন্ত তাঁর পদত্যাগ। স্বাধীনতার পর বিরল সংসদীয় উদাহরণ স্থাপন করে গেলেন জগদীপ ধনখড়। তাঁর এই ইস্তফায় এখনও কেমন যেনো ঘোর কাটেনি মিডিয়ার। যে মিডিয়া কখনও মোদিময় আবার কোনো সময় দিদিময়। যখন যেখানে যেভাবে থাকা দরকার সেটাতে এই ‘ময়’ হয়ে থাকা। স্বাধীন ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে একটা ব্ল্যাক স্পট। নজিরবিহীন কাণ্ড। কিন্তু এত বড় ঘটনা সেই ঘটনার ঘনঘটা লাটাই কার হাতে কে জানে?
কিন্তু এই ক্ষমতায় আসার জন্য যা যা করা দরকার সেটা করে দলের কাছে আর এস এস এর কাছে ভালো হয়ে গুড বয় ইমেজ নিয়ে প্রাইজ পোস্টিং নিয়ে উপ রাষ্ট্রপতি হয়ে কলকাতা থেকে সোজা দিল্লীতে পৌঁছে গিয়ে কাঁচের ঘরে প্রবেশ করে সোজা ঘরের ভিতর চুপ করে বসে থাকা মুর্তিকেই সরাসরি প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া। ক্ষমতায় কে বড়ো তিনি না সেই কাঁচের ঘরে বসে থাকা যোগী ঋষি তুল্য সাদা চুল আর সাদা দাড়ির একটি মানুষ। যিনি বোধহয় এই তাঁকে টপকে যাওয়াটা আবার একদম ঠিক পছন্দ করেন না। যিনি মনে করেন একমাত্র উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হোক তাঁর জীবন আর তাঁর কর্মকাণ্ড। মুছে যাক দেশের ইতিহাস আর ইতিহাসের নানা তথ্য পরিসংখ্যান। সেখানে কে ধনখড় আর কে দেশের উপরাষ্ট্রপতি তাতে তাঁর কী বা আসে যায়। তিনি যত বড় ক্ষমতাধর মানুষ হন তাঁর কাছে যে সবাই সমান। একদম ঠিক ওই মুঘল সাম্রাজ্য চালানো একছত্র অধিপতির মত যিনি রাজনীতির ময়দানে সেই ডনের মতোই দেশ চালান আর বিশ্বের কাছে নিজেকে ‘সাধু’ মহান রাজনীতিক বলেই প্রতিপন্ন করেন।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
সেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কলেজিয়াম বিতর্কের জেরে নরেন্দ্র মোদি জমানায় গঠিত ন্যাশনাল জুডিশিয়াল কমিশন (এন জে এ সি ) সংসদের দুই কক্ষে ২০১৪ সালে পাশ হয়ে আইনে পরিণত হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তার বৈধতা না দিয়ে খারিজ করে। ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বিচার ব্যবস্থ্যার সঙ্গে এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে সংঘাত উভয়ের পক্ষেই যারপরনাই অস্বস্তিকর বিষয় ছিল সেটা। সেই ধনখড় যিনি একসময়ে জনতা দল, কংগ্রেস ঘুরে হাওয়া মোরগের মতোই বাজপেয়ি জমানায় বিজেপিতে যোগ দিয়েও বিশেষ সুবিধা আদায় করে উঠতে পারেননি তিনি। রাজস্থানী জাঠ ধনকর তাঁর জাতিগত পরিচিতি ভাঙিয়ে হরিয়ানায় বিজেপির ২০১৯ সালের বিধানসভা জিততে আসরে নেমেছিলেন। তাঁর পুরস্কার স্বরূপ নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ তাঁকে বাংলায় ‘মমতা দমনে’ রাজ্যপাল করে পাঠান। জাঠ সম্প্রদায়গত তুষ্টিকরনের তাস ও মোদি-শাহের অনুগত হিসেবে রাজ্যপালের মেয়াদ শেষের আগেই উপ রাষ্ট্রপতির পদ পেয়ে যান তিনি শুধু তাঁর এই হাসিমুখ আর মিটিমিটি হাসি ও মোদী ভজনা করেই। কিন্তু ভাগ্যের এমন পরিহাস, যে সেই পদও মেযাদের দু বছর আগেই ছাড়তে হলো। বলা ভালো, বাধ্য হলেন ছাড়তে। কারণ একটাই একটু বেড়ে খেলতে যাওয়া তাঁর।
সেই কংগ্রেসে থাকার সময়ে তাঁর যে অভ্যাস তৈরি হয়েছিল টপকে গিয়ে ক্ষমতার কাছে চলে যাওয়ার অভ্যাস সেটা এই বিজেপির দলে এসে করতে গিয়ে নাগপুর সেটা ভালো চোখে দেখেনি একেবারেই। আর তাই কাঁচের ঘরে পৌঁছে গিয়ে সোজা ঘরের ধ্যান করা ওই মূর্তির মাহাত্ম্য জেনেও তাঁর দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতেই প্রপাত ধরণীতল তাঁর। সেই মোদি-শাহের চাপেই একদম ক্ষমতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েও কি করে যে তাঁর ঘুড়ি কেটে গেলো সেটা বোধহয় তিনি নিজেও বুঝতে পারলেন না কিছুতেই। যার অন্যতম কারণ সেই বিচার বিভাগ। বিতর্কিত বিচারপতি যশোবন্ত ভার্মার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রাথমিক পর্যায়ে আপত্তি ছিল। সেটা কাটিয়ে কিছু কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তার সমর্থন আদায়ে সমর্থ হয় মোদি-শাহর দল। কিন্তু একদা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ধনখড়ের আপত্তি ওই ইমপিচমেন্ট নিয়ে। এর নেপথ্যে কী কারণ, তা একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন। এতেই বেধে গেলো দুপক্ষের দড়ি টেনে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা। আর সেটাই ভালো চোখে নেননি কেন্দ্রের শাসক দলের প্রধান।
ইমপিচমেন্ট প্রসঙ্গে শাসকের মনোভাব বুঝেও তিনি নাচার। ইতিমধ্যে বিজেপি বিরোধী সহ দুই কক্ষের শতাধিক সসস্যের সই সংগ্রহ করে ইমপিচমেন্ট প্রস্তুতি সেরে ফেলে বাদল অধিবেশনের শুরুতেই। বিরোধীয়দের আস্থায় রেখেই সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়। ধনখড়ের পক্ষে তা হজম করা কঠিন হয়ে পড়ে একদম। কারণ তিনি তখন দাবার বোর্ডে ঘোড়ার আড়াই চালে মাত করতে চান কাঁচের ঘরে বসে থাকা ওই ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে। সংঘাত এমন পর্যায়ে ,যে রাজ্যসভায় ইমপিচমেন্ট নিয়ে শাসকের নয়, বিরোধী মল্লিকার্জুন খড়্গেদের আনা মোশনটি বেনজিরভাবে গ্রহণ করে নেন সভার চেয়ারম্যান ধনখড়। আর এতেই চটে লাল মোদী শাহের জুটি। যা বোধহয় কিছুটা শেষ পর্যন্ত নিজের ক্ষমতা কতটা সেটা উপলব্ধি না করেই এই তাঁর একটু বেড়ে খেলা। যে খেলার ফল পেলেন ধনখড় একেবারেই হাতেনাতে। উল্লেখ্য রাজ্যসভার অধিবেশনে খড়্গের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে বিজেপি সভাপতি সংসদ জগৎ প্রসাদ নাড্ডা যেভাবে ভাষনের রেকর্ড করা না করা প্রসঙ্গে কার্যত চেয়ারম্যানকে উপেক্ষা করেই নির্দেশের ঢঙে বলতে থাকেন, তাও বেনজির। ততক্ষণে বার্তা একদম স্পষ্ট, ‘ কালক্ষেপ না করেই পদ ছাড়ুন ‘।
এর আগেই কার্য উপদেষ্টা কমিটির (বি এ কমিটি ) বৈঠকে নাড্ডা ও সংসদীয় মন্ত্রী রিজিজুর অনুপস্থিতিও যথেষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিল, পদাধিকার বলে কমিটির আহ্বায়ক ধনখড়কে। সেটাও বেনজির একদম। সর্বশেষ অধিবেশন শুরুর দিন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তথা উপ রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, এটাও স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে বেনজির। নিঃসন্দেহে মোদি-শাহের পক্ষে যথেষ্ট চাপের এটা। এই পরিস্থিতিতে ইস্তফা ইস্যু বিরোধীদের হাতে নতুন অস্ত্র, সেসব বিলক্ষণ জানতেন মোদি-শাহ এই জুটি। কিন্তু তা সত্বেও ঝুঁকি নিলেন তাঁরা। বাধ্য বাধকতা তাঁদেরও ছিল নির্ঘাত। আদতে কৃতকর্মের ফল। দল বদলাতে পটু একজন কে প্রাপ্যের অতিরিক্ত দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্চে মোদিকে।
তবে সবটাই কি মোদি -শাহের , স্বাধীন সিদ্ধান্ত নাকি ঘুড়ির লাটাই নাগপুরে সেটা কে আর জানে এই গোপন ব্যাপার এর কথা। তবে একদা ক্ষমতার স্বাদ পেতে মরিয়া দেশের উপ রাষ্ট্রপতির এই দশা এটা কিন্তু লেখা থাকবে ভারতীয় সংসদের রাজনীতির ইতিহাসে উজ্জ্বল করে। যেখানে এই নাগপুরের রক্তচক্ষু আর তাদের নজর এড়িয়ে একজন ক্ষমতা লিপ্সায় মত্ত মানুষকে শাস্তি দিতে স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আর দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। যেখানে সেই কঠিন অনুশাসনের মধ্যে থাকা একটি শতাব্দী প্রাচীন দল বিজেপির গায়েও কেমন কংগ্রেসী ঘরানার রাজনীতির ছায়া লেগে যায় তাদের নিজেদের অজান্তেই। যে কংগ্রেস মুক্ত ভারত গড়তে বদ্ধপরিকর বিজেপি। সেই কংগ্রেসের ছায়ায় বেশ কিছুটা অস্বস্তিতে বিজেপি। সেই অস্বস্তি কাটাতেই ‘বলিদান’ দেশের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের।