সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়: পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভিন রাজ্য এবং ভিন দেশে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের নাগরিকত্ব নিয়ে যখন দেশজুড়ে তোলপাড় অবস্থা, তখন পরিযায়ী শ্রমিকদের সঠিক সংখ্যা বা তথ্য নেই সরকারি ভাণ্ডারে। রাজ্য বা কেন্দ্র কারও কাছেই নেই সঠিক পরিসংখ্যান, এমনটাই জানিয়েছেন প্রশাসনিক কর্তারা। অথচ, এই মুহূর্তে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে এই প্রশ্নই—পশ্চিমবঙ্গের কোন জেলা থেকে কত মানুষ কাজের খোঁজে পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে বা ভিনদেশে এবং তাঁদের মধ্যে ঠিক কতজন বৈধ নাগরিক এবং কতজন অবৈধ।
প্রশাসন যা জানে, তা শুধুই সরকার স্বীকৃত ৩৬টি এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে যাওয়া অদক্ষ বা আধা-দক্ষ শ্রমিকদের তথ্য। সেই হিসেব বলছে, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১ লক্ষ ৭৯ হাজার ৫৯৭ জন শ্রমিক কাজ করছেন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কুয়েত, কাতার-সহ মোট ১৭টি দেশে। এই সংখ্যাটি সেই সমস্ত শ্রমিকদের, যাঁরা ‘ইসিআর’ (এমিগ্রেশন চেক রিকোয়ার্ড) তালিকাভুক্ত দেশগুলিতে সরকার অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি শ্রমিক রয়েছেন সৌদি আরবে—প্রায় ৪৫ হাজার। ইউএই-তে রয়েছেন ১৭ হাজার, কুয়েত ও কাতার মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার। কেউ কৃষিকাজে, কেউ নির্মাণক্ষেত্রে, কেউ কাঠ বা লোহা কাটার কাজে যুক্ত, কেউ আবার হোটেল-রেস্তরাঁয় পরিচারক বা সাফাই কর্মী হিসেবে নিযুক্ত।
কিন্তু এই হিসেবের বাইরেও রয়েছে বিশাল এক ‘অদৃশ্য’ পরিযায়ী শ্রমিক শ্রেণি, যাঁরা যাচ্ছেন ভুয়ো এজেন্সির মাধ্যমে, বা আত্মীয়স্বজনের আমন্ত্রণে, অথবা ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে। এই শ্রমিকদের সংখ্যা ঠিক কত, তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট সরকারি পরিসংখ্যান নেই। সরকারি স্বীকৃতি না থাকা বহু বিদেশগামী শ্রমিক নিরাপত্তাহীন অবস্থায় কাজ করছেন, প্রতারিত হচ্ছেন, এমনকী অনেক ক্ষেত্রে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসন সূত্রে খবর, সবচেয়ে বেশি ভুয়ো এজেন্সির খপ্পরে পড়েছেন মুর্শিদাবাদের শ্রমিকরা। গত পাঁচ বছরে এই জেলা থেকেই ৩০ হাজার ২৮১ জন সরকার স্বীকৃত এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে গিয়েছেন, কিন্তু অনুমোদনহীন পথে গিয়েছেন আরও বহু মানুষ, যাঁদের খোঁজ প্রশাসনের কাছেও নেই।
পরিযায়ী শ্রমিক পাঠানোর নিরিখে মুর্শিদাবাদের পরেই রয়েছে নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এবং কলকাতা। শুধু কলকাতা থেকেই গত পাঁচ বছরে ১৮ হাজার ১৭৪ জন শ্রমিক গিয়েছেন সরকার স্বীকৃত পথে এঁরা মূলত খিদিরপুর ও পার্ক সার্কাসের বাসিন্দা। কিন্তু শহরাঞ্চল থেকে ভুয়ো এজেন্সির মাধ্যমে যাওয়া শ্রমিকদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকরা শুধু পশ্চিম এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ নন। আফগানিস্তান, বাহরিন, ইরাক, জর্ডন, লেবানন, মালয়েশিয়া, ওমান, সিরিয়া, থাইল্যান্ড, সুদান, ইয়েমেন—একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশেও ছড়িয়ে রয়েছেন তাঁরা। যদিও লিবিয়ায় আপাতত ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেখানে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ।
বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর নামে জালিয়াতি ও মানব পাচারের ঘটনা যাতে না বাড়ে, সে জন্য নজরদারি এবং স্বচ্ছ তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার তাগিদ আরও জোরালো হচ্ছে প্রশাসনের অন্দরেও। কিন্তু পরিসংখ্যানের এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই ধীরে ধীরে আরও গভীর হয়ে উঠছে এই বিতর্ক—সরকারের নজর এড়িয়ে ঠিক কত মানুষ পাড়ি দিচ্ছেন ‘অদৃশ্য পথে’? আর তাঁদের সুরক্ষার দায় নেবে কে?