পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধা ভারতবর্ষ ভুলেই গিয়েছিল স্বপ্ন দেখতে। স্বপ্নটা নতুন করে দেখতে শেখান স্বামী বিবেকানন্দ। কিন্তু ঘুমন্ত জাতিকে জাগানোর যে রাস্তা স্বামীজি বলেছিলেন, তাকে বাস্তবের রূপ দেবে কে? স্বামীজি দিয়েছিলেন ফুটবলের মাধ্যমে মানুষের চেতনা জাগানোর নিদান। কিন্তু সেই নিদানের তাৎপর্য বুঝতে ঘুমন্ত জাতি ছিল অপারগ। ফলে, প্রয়োজন ছিল একটি বিস্ফোরণের। আর সেটাই ঘটল ১৯১১ এর ২৯ জুলাই। না, নিছকই এক আইএফএ শিল্ড জয় নয়। হোক বা প্রথমবারের মতো। নগ্ন পায়ে গোরাদের বুটের সঙ্গে জোর টক্কর! সবুজ-মেরুন জামা গায়ে মাঠময় দাপিয়ে বেড়ানো ১১টি দামালের হাত ধরে আসলে সেদিন প্রথমবারের জন্য বিশ্বাসটা জন্ম নিয়েছিল ঘুমন্ত, পরাধীন জাতির মননে। হ্যাঁ, আমরাও পারি।
হেস্টিংসের মাথায় তখন পত পত করে উড়ছে ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক। দেখে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন শিবদাস ভাদুড়ী, অভিলাষ ঘোষ, মনমোহন মুখোপাধ্যায়রা। এই সাম্রাজ্যবাদী নিশানকে নামিয়ে তুলতেই হবে দেশের পতাকা। বাকিটা ইতিহাস। প্রথমার্ধে ১ গোলে পিছিয়ে থাকা মোহনবাগান ফাইনালের শেষ ৪৫ মিনিট যে রকম অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল, আসলে সেটা ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির উদ্দেশ্যে আগামীর পূর্বাভাস। যদি ভেবে থাকো, আমরা এখনও পড়ে পড়ে মারই খাব। তা হলে দেখে নাও, নতুন সকালের সূচনা কাকে বলে।
আইএফএ শিল্ড ফাইনাল। সামনে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট। মোহনবাগান সে দিন শুধুমাত্র বাংলার একটি ক্লাব নয়। পালতোলা নৌকোর মাঝিরা সে দিন ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রতিনিধি। গোটা দেশ তাকিয়ে ছিল তাঁদের দিকে। শাসক ব্রিটিশও কি তাকায়নি? অমর একাদশের মাঝমাঠ সামলানোর গুরুদায়িত্ব ছিল যাঁর কাঁধে, সেই মনমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন সে সময়ের রাইটার্সের পিডব্লিউডি ডিপার্টমেন্টের চাকুরে। কিন্তু ম্যাচের দিন অফিসে তিনি ছুটি চাইবেন কী করে? সরকারি কর্মচারী হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধেই খেলতে নামছেন, এ কথা বলা যায় নাকি? ফলে, জরুরি কাজের অজুহাতে ছুটি নিলেও কাজটি কী তা অফিসকে জানাতে পারেননি মনমোহন।
অন্যদিকে মনমোহনের অধিনায়ক তো বরাবরই ইংরেজদের পথের কাঁটা। পেশায় পশু চিকিৎসক শিবদাস ভাদুড়ী ১৯১১ আইএফএ শিল্ডের আগেই মোহনবাগানের হয়ে জিতে ফেলেছিলেন একাধিক শিরোপা। জ্ঞান হওয়া ইস্তক মোহনবাগান অন্তপ্রাণ শিবদাস ১৯০৫ নাগাদ যোগ দেন ক্লাবে। সে বছরই গ্ল্যাডস্টোন কাপের ফাইনালে ৪ গোল দিয়েছিলেন ডালহৌসি এসি’কে। এরপর পরের বছরই কলকাতা এফসি’কে হারিয়ে ক্লাবকে এনে দেন মিন্টো ফোর্ড টুর্নামেন্টের শিরোপা। মাঠে শিবদাসের বল ট্যাকলিংয়ের কৌশল দেখে সাহেবরা তাঁর নাম দিয়েছিলেন, ‘Slippery Shibdas’ বা ‘পিচ্ছিল শিবদাস’। গোটা মাঠজুড়েই ছিল শিবদাসের রাজত্ব।
কম যেতেন না শিবদাসের দাদা বিজয়দাস ভাদুড়ীও। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বরিশালের ছেলে শিবদাসরা ছিলেন মোট ৬ ভাই। এক ভাই বাদে সকলেই খেলেছেন মোহনবাগানের হয়ে। ছোট ভাইয়ের নেতৃত্বে দাদা বিজয়দাসও ছিলেন ১৯১১ আইএফএ শিল্ডজয়ী অমর একাদশের অন্যতম সদস্য। গোরাদের বুটের লাথি অগ্রাহ্য করে ভাইয়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে আক্রমণ চালিয়েছিলেন ঔপনিবেশিক শক্তির গোলে। সঙ্গে ছিলেন অভিলাষ। মনমোহনের বাড়ানো বল জালে জড়িয়ে যিনি সে দিন নিজের হাতে— থুরি পায়ে সূচনা ঘটিয়েছিলেন নতুন যুগের। যে যুগ বহমান আজও। যে যুগের আকাশে একইসঙ্গে সগৌরবে উড়ছে স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা এবং জাতীয় ক্লাব মোহনবাগানের পতাকা।