‘ছোটে নৌকাগুলি; প্রানপনে ফেলে জাল, টানে দড়ি
অর্ধনগ্ন যারা, তারা খাদ্যহীন, খাদ্যের সম্বল।
রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শষ্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব’।
বুদ্ধদেব বসুর মনোরম এই আখ্যানে মনের সুখ মেটে বটে, কিন্তু না-পাওয়ার আকুল বাসনায় জিভ লকলক করে, লালা ঝরে, নাকে ইলিশ সর্ষের ঘ্রাণ পেতে শরীর ছটফট করে। গায়ে আকাশছোঁয়া দামের ছ্যাঁকা লাগলেই ইলিশপ্রিয় বাঙালি মনখারাপের গর্তে সেঁধিয়ে যায়।
কমলকুমার বলতেন, পদ্মার ইলিশের থেকে নাকি গঙ্গার ইলিশের স্বাদ বেশি কারণ তারা দুশো বছর কোম্পানির তেল খেয়েছে! এখন জিপিএসে বোঝা যায় মাঝ সমুদ্রে কোথায় ইলিশের ঝাঁক আছে। কিন্তু আগে ট্রলারের মাঝি-মাল্লারা জলের গন্ধ শুঁকে, জলের রং দেখে বলে দিতেন ঠিক কত দূরে অবস্থান করছে ইলিশের ঝাঁক। কীভাবে ধরা হয় ইলিশ, কত রকমের জাল আছে ইলিশ ধরার জন্য, একটি পূর্ণাঙ্গ ইলিশের গায়ে কটি কাঁটা, মাছ ধরার পর ট্রলার থেকে মাছ আমাদের কাছে পৌঁছনো পর্যন্ত যে বিপুল কর্মকাণ্ড; মাঝে মাঝি-মাল্লাদের যে করুণ জীবনকাহিনি, তা জানতে বয়েই গেছে বাঙালির। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হলেই পাতে চাই রুপোলি ফসল।
আসলে ইলিশ বাঙালিকে প্রেমিক করে তোলে, দার্শনিকও। ইলিশে বাঙালি রাজা, ইলিশেই ফকির। ইলিশে বাঙালি দিলদরিয়া। ইলিশই জীবনমুখী গান। ইলিশে প্রাণ সঁপে বাঙালি দিব্যি আছে। ইলিশ-বাঙালি সম্পর্ক আকাশ বেয়ে বৃষ্টি গড়ালেই মাখোমাখো। তাই না পেলে হাহুতাশ, প্রাণ ছটফট। কারণ, ইলিশ মাছের সঙ্গে বাঙালির কেবল পেটের নয়, প্রাণের টান। একটা গোটা জাতির জীবনে আর কোনও খাবার এতখানি গুরুত্ব পেয়েছে কি না, জানা নেই। কত যে পদ! ইলিশ ভাপা, আনারস ইলিশ, ইলিশের অম্বল, ল্যাঞ্জাভর্তা, ইলিশ মাছের উল্লাস থেকে ‘ধূমপক্ব ইলিশ’, অর্থাৎ কিনা ‘স্মোকড হিলসা’। মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে ইলিশ না পাওয়া গেলে কি আর ‘কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে-ঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ’ ও ‘সরস সর্ষের ঝাঁজে’ বর্ষার সঙ্গে ‘ইলিশ উৎসব’–এর যুগলবন্দির সাক্ষী হতে পারতেন বুদ্ধদেব বসু! কিংবা বিভূতিভূষণের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’?
অবশ্য যে ইলিশে বাঙালির স্বাদকোরক মশগুল, সে ইলিশ মাঝে মাঝে ভেলকি দেখায়। এই আছে এই নেই। মার্কেট থেকে উধাও। কড়ায় ছ্যাঁকছোঁক শুনতে আর ইলিশের গন্ধ পেতে হেদিয়ে মরে বাঙালি। পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ মাছে পেঁয়াজ–রসুন ও আলু–আদার রেওয়াজ নেই। তবে ওপার বাংলার মত অন্য, পথও ভিন্ন। মাংসের বিরিয়ানির পাশে ইলিশের সহাবস্থানও সেখানে ঘটে যায় অনায়াসেই। ইলিশের মসনদে এমন শরিকি ভাগ মানতে নেহাত নারাজ ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ইলিশের চেয়ে মাংসের বিরিয়ানি কাছে টানার ‘অপরাধে’ এক অধ্যাপকের সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বন্ধ রেখেছিলেন তিনি।
কতদিন পর ইস্টবেঙ্গল ডার্বি জিতল। কোথায় জোড়া ইলিশ কিনে বাড়ি ফিরবে লাল-হলুদ সমর্থকেরা, তা নয়, বাজারে নাকি পুরুষ্ট ইলিশের বেজায় টান। তবে ফুটবল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভাজিত বাঙালি যখন গঙ্গা–পদ্মার ইলিশের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের বিচার করতে বসে, তখন তারাই একজোট হয়ে ঝোল টানে গঙ্গার কোলে। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হলে কী হয়, ইলিশকে কিন্তু ত্যাগ করেননি স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। রবীন্দ্রনাথের ইলিশপ্রীতি সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্য জানা যায় না বটে, তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অনুমান করেছিলেন, ‘পদ্মার ওপর বোটে অনেক দিন চেপেছেন, মাঝে মধ্যে কি ইলিশ চেখে দেখেননি?’ তা ছাড়া আবদুল মাঝির কথাও তো তিনি নিজেই লিখেছেন। সেই আবদুল মাঝি, পদ্মা থেকে দাদাকে ইলিশ মাছ আর কচ্ছপের ডিম এনে দেওয়ার সূত্র ধরেই যার সঙ্গে চেনাজানা কিশোর রবির। একটা সময় ছিল, যখন একটি ইলিশ মাছ ভাজলে তার সুগন্ধে পাড়া ভরে যেত, এখন তো তা হয় না। ইলিশ মাছ গন্ধ হারাচ্ছে, না আমাদের মনের আনন্দ পাওয়ার ক্ষমতা চলে যাচ্ছে, কে জানে! মাছের সঙ্গে যেন রসিকেরাও নিপাত্তা। শুধু ইলিশ মাছ কেন, জীবনের যাবতীয় রস হারিয়ে ফেলতে ফেলতে সেই আক্ষেপটুকুই বুঝি এখন পড়ে আছে বাঙালির শেষপাতে।
টন টন ইলিশ নিয়ে সুন্দরবনের বন্দরগুলোতে ফিরেছে হাজার হাজার মৎস্যজীবী ট্রলার। তবে বাজারে ইলিশের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় আকাশছোঁয়া দামে ছ্যাঁকা খাচ্ছে ইলিশপ্রিয় বাঙালি। তাই বাজারের চাহিদা পূরণে ভরসা করতে হচ্ছে স্টোর করে রাখা মায়ানমারের ইলিশের ওপর। গত ১৫ জুন থেকে ইলিশের সন্ধানে গভীর সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে মৎস্যজীবী ট্রলারগুলি। ক্ষেপে ক্ষেপে ধরে আনছে টন টন রুপোলি শস্য। মূলত প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন এবং প্রজনন বৃদ্ধির জন্য ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত বাংলার বঙ্গোপসাগরে মৎস্য শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন। প্রতিবছরই এই দু’মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ১৪ জুন মধ্যরাত থেকেই বাংলার মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মৎস্য বন্দরগুলি থেকে গভীর সমুদ্রে ইলিশের সন্ধানে পাড়ি দেয় মৎস্যজীবী ট্রলারগুলি। টানা দুটমাসের ব্যান পিরিয়ড কাটিয়ে এবারের ইলিশের মরশুমে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার রায়দিঘি, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ, সাগর, নামখানা এবং ফ্রেজারগঞ্জ বন্দর থেকে প্রায় চার হাজার মৎস্যজীবী ট্রলার ইলিশের সন্ধানে সাগর জলে ভেসেছে। সমুদ্রে পুবালি হাওয়া এবং অবিরাম বৃষ্টির ফলে মৎস্যজীবীদের জালে ধরা পড়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে রূপোলি ফসল। মরশুমের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জ, রায়দিঘি, পাথরপ্রতিমা সহ বিভিন্ন বন্দরে ওই মৎস্যজীবী ট্রলারগুলি প্রায় ৪০০০ টন ইলিশ নিয়ে ফিরেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক একটি ইলিশের ওজন প্রায় ৭০০ থেকে ১ কিলোর মধ্যে। এই ইলিশ ডায়মন্ডহারবারের নগেন্দ্র বাজারের মাছের আড়ত ঘুরে পৌঁছে যাচ্ছে শহর কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে। পাইকারি বাজারে এই ইলিশ বিকোচ্ছে ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা প্রতি কেজি। তবে খোলা বাজারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ইলিশের দাম বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা প্রতি কিলো। মানে, ছ্যাঁকা খাচ্ছে মধ্যবিত্তরা। মৎস্যজীবী সংগঠনগুলোর দাবি, বিগত বছরগুলির তুলনায় বর্তমান বছরে ইলিশের আমদানি অনেকটাই কম। সমুদ্রে ভাল পরিমাণে ইলিশের দেখা মিললেও বারে বারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সর্তকতা পেয়ে বেশিরভাগ সময় বন্দরেই আটকে থাকতে হচ্ছে মৎস্যজীবী ট্রলারগুলিকে। তাই বাজারে ইলিশের চাহিদা পূরণ করে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে খোলা বাজারগুলিতে চড়া দামে বিকোচ্ছে ইলিশ। অন্যদিকে বেশ কিছু অসাধু পাইকারি ব্যবসায়ী ট্রলারগুলি থেকে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ কিনে সঙ্গে সঙ্গে বাজারজাত না করেই স্টোর করে রাখছে। ধাপে ধাপে সেই ইলিশ স্টোর থেকে বের করে চড়া দামে বিক্রি করছে। পাশাপাশি শহর কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে এখনও বিকোচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে স্টোর করে রাখা মায়ানমারের ইলিশ। যে ইলিশ স্বাদে-গন্ধে নেহাতই তুচ্ছ। তবে মৎস্যজীবীদের দাবি, সমুদ্রে পুবালি বাতাস আর অবিরাম বর্ষণে বঙ্গোপসাগরে ভাল পরিমাণে ইলিশের দেখা মিলছে। আগামী দিনগুলিতে সেভাবে দুর্যোগ পরিস্থিতি তৈরি না হলে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলিশ শিকার করে আনতে পারবে তারা। বাজারে ইলিশের চাহিদা পূরণ হলেই কমবে দাম। তাই ভোজনরসিক বাঙালিদের হেঁশেলে খুবই সহজে স্বাদে গন্ধে ভরপুর বঙ্গোপসাগরের রুপোলি শস্য পৌঁছনো তাই শুধু সময়ের অপেক্ষা।
Leave a comment
Leave a comment