আজ শনিবার থেকেই রাজ্যজুড়ে শুরু হচ্ছে “পাড়ায় সরকার “। নিজের পাড়ার সমস্যার সমাধানে পাড়াতেই পৌঁছে যাবে সরকারি দপ্তর। স্থানীয় বাসিন্দাদের উন্নয়নের কাজকে সঙ্গী করে স্থানীয় সমস্যার সমাধান হবে সরকারি উদ্যোগে। এই লক্ষ্যে ‘ দুয়ারে সরকার ‘- এর পরে ‘ আমার পাড়া, আমার সমাধান ‘ ছাব্বিশের নির্বাচনের আগে রাজ্য সরকারের অন্যতম ফ্লাগশিপ প্রোগ্রাম। ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পে কোন কোন কর্মসূচি রূপায়িত হবে, রাজ্য সরকারের ভূমিকা কী হবে, স্থানীয় মানুষজনের এই প্রকল্পে অংশীদারিত্ব কীভাবে হবে এবং প্রকল্পের কার্যকারিতা বা গতিপথ কীভাবে এগোবে– এই সমস্ত কিছু উল্লেখ করে টেন্ডার অপারেটিং প্রসিডিউর বা এসওপি প্রকাশ করেছে রাজ্য পরিকল্পনা দপ্তর। প্রাথমিকভাবে ১৪টি স্থানীয় উন্নয়নমূলক কর্মসূচিকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পরে আরও দুটি কর্মসূচি এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম স্থানীয় রাস্তাঘাট সংস্কার বা উন্নয়ন। রাজ্যে ইতিমধ্যেই অতিবৃষ্টির জেরে জেলায় জেলায় রাস্তাঘাটের অবস্থা কঙ্কালসার হয়েছে। রাস্তার সমস্যায় জেলাযর সাধারণ মানুষ এলাকায় এলাকায় বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন। ২৬ এর নির্বাচনের আগে এই পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত নয় বুঝেই রাজ্য সরকার নতুন এসওপি প্রকাশ করে স্থানীয় রাস্তাঘাটের সংস্কারকে এই ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রামের আওতাভুক্ত করেছে বলে জানিয়েছে প্রশাসনের একাংশ। মানুষের দৈনন্দিন জীবন ধারনের সঙ্গে যুক্ত সমস্যাগুলির সমাধানকেই এই নয়া প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করেছে রাজ্য সরকার। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনও কর্মসূচি বা আইনি জট রয়েছে, এ ধরনের কোনও কর্মসূচিকে এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত করা যাবে না বলেও আগেই জানিয়েছে রাজ্য সরকার। প্রতিটি প্রকল্পের কাজ হতে হবে সরকারি জমিতে। প্রকল্প শুরু করার আগে সেই জমিতে কোনও আইনি জটিলতা রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখে তবেই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে হবে বলে এসওপি-তে স্পষ্ট জানিয়েছে রাজ্য পরিকল্পনা দপ্তর। দশ লক্ষ টাকার মধ্যে প্রকল্পের মূল্যমান নির্ধারিত করা হয়েছে। অর্থাৎ বড় কোনও কাজের প্রকল্প এই কর্মসূচির আওতায় থাকবে না। প্রতিটি কর্মসূচি রূপায়নের সময়সীমা ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। পুজোর দিনগুলি ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। সমস্ত প্রকল্পের কাজ শেষের চূড়ান্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ১৫ জানুয়ারি। মূলত, স্থানীয় রাস্তাঘাট উন্নয়ন, ড্রেনেজ বা নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়ন, টিউবওয়েল বা জল সরবরাহ করার পাইপ লাইনের সুবন্দোবস্ত, বিদ্যুতের খুঁটি বা রাস্তার আলোর উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা, লিঙ্গভিত্তিক শৌচাগার তৈরি বা বায়ো টয়লেটের ব্যবস্থা, সামাজিক শৌচাগারের উন্নয়ন, স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন বা সংস্কার, স্থানীয় আইসিডিএস বা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের উন্নয়ন ও সংস্কার, পুকুর বা জলাশয় খনন, স্থানীয় বাজার বা হাট উন্নয়ন, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা, সার্বজনীন স্থান উন্নয়ন, কমিউনিটি শেডের উন্নয়ন, স্থানীয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিকাঠামোর উন্নয়ন সহ বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় উন্নয়নের কাজ এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত করেছে রাজ্য সরকার। প্রকল্পের বিধি অনুযায়ী রাজ্যের প্রতি তিনটি ভোটের বুথ এলাকায় একটি করে ক্যাম্প তৈরি করা হবে। সেই ক্যাম্পে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের সরকারি আধিকারিকরা উপস্থিত থাকবেন। ক্যাম্পে থাকবেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিরাও। স্থানীয় মানুষজনও এই ক্যাম্পের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। সরকারপক্ষ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় মানুষ একযোগে এই উন্নয়নের শরিক হবেন।
মুখ্যমন্ত্রীর মতে, ” আর সরকারের কাছে আপনাদের আসতে হবে না, সরকার আপনাদের কাছে যাবে।”
যদি ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের এই প্রকল্পকে ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। একুশের নির্বাচনের আগে ২০২০ সালের পয়লা ডিসেম্বর ‘দুয়ারে সরকার।’ এবার ছব্বিশের আগেই ‘ আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান ‘ নামে নয়া প্রকল্প যাকে দুয়ারে সরকারের
‘ মিনিয়েচার ‘ বা ‘ ক্ষুদ্র সংস্করণ ‘ বলা যেতেই পারে। অর্থাৎ নির্বাচনমুখী বাংলায় দুয়ারে সরকারের পর এবার ‘পাড়ায় সরকার’।
একুশেও জয়ধারা অব্যাহত রেখে জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকের কর্মসূচিতে কিছুটা ভাটা পড়লেও ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প শাসক-মানুষ নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখতে কার্যকরী ভুমিকা নিয়েছে। এখানেই প্রশ্ন, আরও একটা নির্বাচনের আগে নতুন করে একই ধাঁচে ফের একটা সরকারি প্রকল্পের তড়িঘড়ি ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা কেন? রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, রাজ্যে ইতিমধ্যেই ছাব্বিশের ভোটের দামামা বেজেছে। আর নির্বাচন মানেই মানুষের কাছে দরবার, এটা সাধারণ মানুষ বুঝুক, না বুঝুক রাজনৈতিক দলগুলো বিলক্ষণ বোঝে। তাই আগে থেকেই ভোট রাজনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত রাখে তারা। নবান্নর এই নয়া কর্মসূচি তারই অঙ্গ। রাজ্যে ভোটের বুথের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। আর প্রতি তিনটি বুথ নিয়ে একটি ক্যাম্প অর্থাৎ প্রায় ২৭ হাজারের কাছাকাছি এই পাড়ায় সমাধান ক্যাম্প করবে রাজ্য সরকার। রাজ্যের শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকা রাজ্য সরকারি কর্মী ফেডারেশনের সদস্য সংখ্যা লক্ষাধিক। এই অনুগত সরকারি কর্মীদের জেলায় জেলায় কাজে লাগিয়ে ছাব্বিশের পরীক্ষায় বসতে চান মুখ্যমন্ত্রী বলেও মনে করা হচ্ছে। মানুষের মন বুঝতে পাড়ায়-পাড়ায় ক্যাম্প তৈরির চেষ্টা বলে মনে করছেন বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ। বিপক্ষের যুক্তি, ছোট ছোট যে সমস্যার কথা মুখ্যমন্ত্রী বলছেন তা করার জন্য স্থানীয় স্তরে পঞ্চায়েত অথবা পুরসভা রয়েছে। পঞ্চায়েতের ত্রিস্তরে সেই কাজগুলি দেখাশোনার দায়-দায়িত্ব নির্দিষ্ট সরকারি পরিকাঠামো অনুযায়ী বিন্যস্ত রয়েছে। দুয়ারে সরকার প্রকল্পের মাধ্যমে নব্বই শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে বলেও দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তা সত্ত্বেও সরকারি ব্যবস্থাপনায় পাড়ায় পাড়ায় এ ধরনের কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই বলে বিরুদ্ধ মত। প্রশাসনের নিচুস্তরে বা শাসকদলের তৃণমূল স্তরে ভরসা করছে না নবান্ন? রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে এই প্রশ্নও উঠেছে প্রশাসনের অন্দরে।
যেহেতু ছাব্বিশের নির্বাচনে এখন থেকেই দুর্নীতি ও অনুন্নয়নের পাশাপাশি বাংলা ভাষা বা বাংলাদেশি এবং ভোটার তালিকা অন্যতম প্রধান ইস্যু হতে চলেছে সে কারণে গ্রাম গ্রামান্তরে পাড়ায় পাড়ায় সরকারি মেকানিজমকে কাজে লাগিয়ে ভোটের পরিবেশ এবং ভোটারদের হাল- হকিকত জেনে পুরনো কর্মসূচিকে নতুন মোড়কে বেঁধে মানুষের আরও কাছে পৌঁছতে চায় রাজ্যের শাসক দল বলেও রাজনৈতিক মহলের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। ” ছোট সমস্যার সমাধানে মানুষ খুশি হয়। সরকার ছোট ছোট ক্ষেত্রেও তাদের কথা মাথায় রেখেছে এটা তাঁরা বুঝতে পারেন। এই কর্মসূচি মূলত উপর থেকে নয়, নীচে নেমে মানুষের কথা শোনা” – – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্যের মধ্যেই সেই রাজনৈতিক ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে দাবি একাংশের।