স্নিগ্ধা চৌধুরী
আজ শান্তিনিকেতনের সকালটা যেন একটু অন্যরকম ছিল। অগস্টের নরম আলো, হালকা বাতাসে কাঁপছে শিমুলতলার পাতা, আর তারই ফাঁকে কোথাও যেন মিলেমিশে আছে অশ্রুর গোপন আভা। আজ কবিগুরুর মৃত্যুবার্ষিকী। অথচ শান্তিনিকেতন যেন তাঁর মৃত্যু মানতেই নারাজ! কারণ তিনি তো এখানেই, প্রতিটি ইটের গায়ে, প্রতিটি গাছের পাতায়, প্রতিটি সুরের মধ্যে জীবন্ত।
বৈতালিকের সুরে পথ চলা শুরু হয়েছে “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে” গান যেন পায়ের তালে তালে ছড়িয়ে পড়ছে আশ্রমচত্বরের প্রতিটি কোণে। কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত, চোখে অনন্তের স্বপ্ন, চোখে জল নিয়েই সবাই হাঁটছে ধীর পদক্ষেপে, যেন সময়ের স্রোত উল্টে গিয়ে পৌঁছে দিয়েছে সেই দিনে, যেন মনে হয় তিনিও ছিলেন এই পথের সঙ্গী।
গাছপালাও যেন নত হয়ে শুনছে এই সঙ্গীত। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সুর, সেই সুরে মিশে আছে তাঁর অবিনাশী উপস্থিতি। বৈতালিকের পদযাত্রা যেন কবিগুরুর প্রতি সকালের প্রথম প্রণাম, যা গানের স্রোতে ভেসে যায় উপাসনা মন্দিরের দিকে।
ধীরে ধীরে সুরের এই মিছিল এসে পৌঁছয় মন্দিরের সামনে। এখানে বাতাস আরও গাঢ় হয়ে আসে ধূপের গন্ধে, আরও কোমল হয় সকালের আলোয়। সবাই আসন নেয়, ছাত্র শিক্ষক, প্রাক্তনী, গ্রামবাসী, কেউ কারও আলাদা নয়। সাদা পোশাকের সারির ভেতর, আলো-ছায়ার খেলার মতো ভাসছে প্রার্থনার আবহ।
উপাসনার শুরুতেই নীরবতা ভেঙে মৃদু ধ্বনিতে উচ্চারিত হয় প্রার্থনার মন্ত্র। বৈতালিকের সুর যেন মন্ত্রের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় গান থেকে ধ্যান, সুর থেকে নীরবতা।
আজকের সকালও যেন সেই প্রভাত, যেখানে তাঁর স্মৃতি আর প্রার্থনা এক হয়ে আছে।
প্রার্থনার মধ্যে সবার মুখে শান্তি, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত আলো, এ আলো গর্বের, এ আলো ভালোবাসার। কারণ তিনি যে শুধু কবি নন, তিনি এই ভূমির প্রাণ, এই আশ্রমের আত্মা। তাঁর সেই ডাক আজও বাজে প্রতিটি হৃদয়ে, প্রতিটি কণ্ঠে।
শেষ প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের আলো জানালা ভরিয়ে দেয়। সবাই বাইরে বেরিয়ে আসে, কিন্তু মনে হয়, গান, সুর আর প্রার্থনার সেই মেলবন্ধন এখনও ভাসছে বাতাসে। যেন কবিগুরু নিজেই ধীরে ধীরে হাঁটছেন উপাসনা মন্দির থেকে শিমুলতলার পথে, আর আমাদের কানে ফিসফিস করে বলছেন
“আলো আমার আলো, ওগো আলোয় ভুবন ভরা…”
মৃত্যুর ওপার থেকেও তিনি এই আলো, এই গান, এই প্রার্থনায় আমাদের সঙ্গে আজও আছেন।