জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়
কাশ্মীরে কিছু মহিলা কোরাণের মধ্যে তাঁদের নিখোঁজ সন্তানের ছবি রাখেন। প্রতিদিন সকালে তাঁরা যখন সেই কোরাণ পড়তে যান তখন সেই ছবি দেখে আনন্দে পুলকিত হন। কিছু মহিলা আবার মুখ বুজে থাকেন।তাঁদের বিশ্বাস সন্তান অবশ্যই একদিন ফিরে আসবে। কিছু মহিলা প্রিয়জনের কাল্পনিক আগমন নিয়ে শূন্য দেওয়ালের সঙ্গে কথা বলেন। কিছু মহিলা আবার প্রতিদিনই তাঁর সন্তানদের স্কুল যাওয়ার জন্য টিফিন তৈরি করেন, ইস্ত্রি করেন জামাকাপড়। কাশ্মীরে অধিকাংশ বাড়িতে ধরা পড়ে এই ছবি। কাশ্মীরে গত কয়েক দশক ধরে চলা সংঘাতের জেরে অনেকেই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। এই সংঘাতের সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলছে আরও এক সংঘাত। সেটা হল অপেক্ষার সঙ্গে লড়াই। যে প্রিয়জন একদিন চলে গিয়েছে আর কখনও ফেরেনি তার অপেক্ষায় সময়ের সঙ্গে চলছে যুদ্ধ। যে অপেক্ষার কখনও অবসান হবে বলে মনে হয় না। হতভাগ্য মায়েদের আশা, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জন বা সন্তান নিশ্চিতভাবেই একদিন বাড়ি ফিরবে। এই যুদ্ধ যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সঙ্গে নয়। বরং এই যুদ্ধ নিজের অন্তহীন স্মৃতির সঙ্গে। যেখানে ঘরের প্রতিটি জিনিসে ধরা পড়ে প্রিয় সন্তানের উপস্থিতি। কাশ্মীরে দীর্ঘদিন ধরে যে সঙ্ঘাত চলছে তাতে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন অনেকেই। যা মায়েদের মনে তৈরি করেছে এক গভীর ক্ষত। যে ক্ষত সারার নয়। বরং পুনর্মিলনের আশায় এক চিরস্থায়ী আশাকে জাগিয়ে রাখে এই ক্ষত। কিন্তু আশার বুদবুদ তাঁদের মানসিক আঘাতকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। সন্তানহারা মায়েদের অনুমান, নাড়িছেঁড়া হারানো ধন আজও জীবিত। তাই হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের খোঁজে তাঁদের অনন্ত অপেক্ষা। প্রিয়জনদের অনুপস্থিতি শুধু যে পরিবারগুলির শারীরিক, আর্থিক, সামাজিক স্বাস্থ্য ভেঙে দিয়েছে তা নয়, পরিবারগুলির মানসিক স্বাস্থ্যকেও একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। যা কোনওভাবেই ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। বিশ্বের অনেক জায়গায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। কাশ্মীরি সমাজেও যা ব্যতিক্রম নয়। এই মায়েরা নীরবে বাঁচতে শিখেছেন।মানসিকভার একাই বহনের দক্ষতা অর্জন করেছেন। মানসিক যন্ত্রণার অদৃশ্য ক্ষত তাদের মনে গেঁথে রয়েছে। প্রতিনিয়ত মানসিক উদ্বেগ ও যন্ত্রণা তাঁদের বিষণ্ণতার আরও গভীরে টেনে নিয়ে যায়। এই মায়েদের অধিকাংশই জানেন না যে, তাঁরা বন্ধ দরজার আড়ালে এক অদ্ভুত বিষণ্নতার মধ্যেই কীভাবে বেঁচে আছেন।

 
			 
			 
                 
                                