স্নিগ্ধা চৌধুরী
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। মেয়েটা নেই হয়ে গেছে, দেখতে দেখতে তিনশো পঁয়ষট্টিটা দিন কেমন করে কেটে গেল। রাতের কল্লোলিনী তিলোত্তমার নিয়ন আলোর তেজ দুম করে ফিকে হয়ে গেছে। আঁধারের গাঢ়তা জাপ্টে ধরে প্রতি রাতে। সন্তানের হাহাকার কানে বাজে, মায়ের কোলে কিংবা বাবার স্নেহচ্ছায়াও যে সন্তানকে বাঁচাতে পারেনি, ফিরিয়ে আনতে পারেনি আদরের মেয়েটাকে। প্রতি রাতে সে আর বাড়ি ফেরে না। রাস্তায় পিছলে পড়া আলো নিস্তেজ হয়ে আসে, ভোর হয়, তবুও চোখে ঘুম আসে না হাত বাড়িয়ে বিচারের আঙিনায় সন্তান ভিক্ষা করে ফেরা বাবা-মার। মধ্যবিত্ত পরিবারের পলেস্তারা খসা দেওয়াল যেমন চুনের অপেক্ষা করে, তেমনই সন্তানের অপেক্ষা করে থাকে মা-বাবা।
প্রশ্নের পর প্রশ্ন, তবুও উত্তর মেলে না। কেউ উত্তর দেয় না। তারিখ পে তারিখ, তদন্ত গড়িয়ে চলে, বিচার মেলে না, ফাঁকা হয়ে যায় বুক, আর্তনাদের শব্দও কেমন কাতর হয়ে আসে। অসহায়তার নির্মম যূপকাষ্ঠে বলি হতে থাকে মধ্যবিত্তের বাসনা, স্বপ্ন। চশমার আড়ালে চোখের জল শুকিয়ে যায়, দু-এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে, প্রতিবাদের সুনামিতে হয়ত রূপ পায়, তবুও অধরা থেকে যায় বিচার, স্বপ্নের শিখরে চড়ার আগেই গড়িয়ে পড়ে যায় ন্যায়। অসহায় মা-বাবা যেন একটা বছরে আরও অনেকটা বুড়িয়ে যায়, গলার শির ফোলানো চিত্কারও কানে পৌঁছয় না রক্ষকদের।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের তরুণী চিকিৎসকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার কি মিলবে? প্রশ্ন করে করে ক্লান্ত স্বরও একদিন বুজে আসে, বিচার মেলে না। ধর্ষণ ও খুনের যন্ত্রণার তীব্রতা কুরে কুরে খেয়েছে মেয়েটাকে। তার মাকেও। তাই তো মনের একরাশ যন্ত্রণা উগরে দিয়ে বলে ওঠেন, প্রতি রাতে যেন আমার মেয়ের চিৎকার কান পেরিয়ে আসে, ঘুমোই না, ঘুমোতে পারি না, দুচোখের পাতা এক করতে পারি না। এই বুঝি মেয়েটা এসে বলবে, মা, এখনও তুমি খাওনি? বাবা কি শুয়ে পড়েছে মা? মেয়ের মুখটা ভেসে উঠলেই চিত্কার করে ওঠেন মা, বিচার চাই, বিচার। দোষীদের কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। অভয়ার মায়ের অভিযোগ, তদন্তের নামে গাফিলতি ও প্রভাবের ছায়া পড়েছে মামলার ওপর। আমার মেয়ের জন্য লড়াই করছি, পয়সা কিংবা প্রভাবের জন্য নয়। যারা দোষী, তাদের যেন ঘুমেও শান্তি না হয়।
তরুণী চিকিৎসক ডিউটি শেষে সেমিনার হলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। পরদিন সকালে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। এখনও পর্যন্ত মাত্র একজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। প্রাক্তন সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি। জেলের বাগানে কাজ করছে দৈনিক আশি টাকা মজুরিতে। নির্লিপ্ত, উদাসীন। শুধু একজনই? বিশ্বাস করেন না মা। আরও অনেকের নাম রয়েছে অভিযোগে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী একাধিক মানুষ ও আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের উচ্চপদস্থ কর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও কার্যকর পদক্ষেপ হয়নি বলেই অভিযোগ অভয়ার মা-বাবার।
অভয়ার পরিবারের এই যন্ত্রণাময় আক্ষেপের মধ্য দিয়ে ‘রাত দখল’ আন্দোলনের আন্দোলনকারীরাও আরও সশক্ত হচ্ছে। মামলার দ্রুত ও সঠিক নিষ্পত্তির দাবিতে বিক্ষোভ চলছে। লক্ষ কণ্ঠে গর্জন উঠছে, আর কবে? আর কবে? এই হত্যাকাণ্ড এবং বিচারবঞ্চিত পরিবারের আকুতি দেশের নারী-নিরাপত্তা ও বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতার ওপর গভীর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সুবিচার কি মিলবে? এই দেশের নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কতটা কঠোর হবে সরকার? নাকি, বিচারের পাতায় পাতায় পলি জমবে, একটু একটু করে বিবর্ণ হয়ে যাবে সে সব পাতা? মেয়ের ছবি বুকে চেপে ধরে কাটিয়ে দিতে হবে বাকিটা জীবন? ইতিহাসও কি ব্যর্থ অনুশোচনায় দগ্ধ হবে? উত্তর নেই। উত্তর মেলে না।
